হযরত আবু সাঈ’দ খুদরী রদিয়াল্লহু আ’নহু এর পিতার ইন্তেকাল

হযরত আবু সাঈ’দ রদিয়াল্লহু আ’নহু বর্ণনা করেন, আমাকে উদুহের যুদ্ধের জন্য পেশ করা হইল। আমার বয়স ছিল তের বছর। রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম কবুল করিলেন না। আমার পিতা সুপারিশও করিলেন যে, তাহার যথেষ্ট শক্তি আছে এবং হাড়ও মোটা আছে। রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম আমার দিকে দৃষ্টি উঠাইতেছিলেন এবং নামাইতেছিলেন। অবশেষে অল্প বয়স্ক হওয়ার কারণে অনুমতি দিলেন না। আমার পিতা ঐ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করিলেন এবং শহীদ হইয়া গেলেন। কোন ধন সম্পদ কিছুই ছিল না। আমি রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমতে কিছু চাওয়ার উদ্দেশ্যে হাজির হইলাম। রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে দেখিয়া এরশাদ করিলেন, যে সবর করে আল্লহ তায়া’লা তাহাকে সবর দান করেন, যে আল্লহ তায়া’লার নিকট পবিত্রতা চায় করে আল্লহ তায়া’লা তাহাকে পবিত্র করিয়া দেন। আমি রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম হইতে এই কথাগুলি শুনিয়া আর কিছু না চাহিয়াই চুপচাপ ফিরিয়া আসিলাম। ইহার পর আল্লহ তায়া’লা তাঁহাকে ঐ মর্যাদা দান করিলেন যে, কম বয়সের সাহাবীগণের মধ্যে তাঁহার মত বড় মর্তবার আলীম আরেকজন পাওয়া সুষ্কর বায়পার। (ইসাবাহ, ইস্তীআব)

গাবায় হযরত সালামাহ ইবনে আকওয়া রদিয়াল্লহু আ’নহু এর দৌড়

গাবা মাদীনা তইয়্যেবা হইতে চার পাঁচ মাইল দূরে অবস্থিত একটি আবাদী ছিল। সেখানে রসুলুল্লাহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের কিছু উট চরিত। কাফেরদের একদল লোকসহ আব্দুর রহমান ফাযারী উটসমূহ লুট করিয়া নিল, উটের রাখালকে হত্যা করিয়া ফেলিল। এই লুটতরাজকারীরা ঘোড়ায় সওয়ার ছিল এবং সশস্ত্র ছিল। ঘটনাক্রমে হযরত সালামাহ ইবনে আকওয়া রদিয়াল্লহু আ’নহু সকালবেলায় তীর ধনুক লইয়া পায়ে হাঁটিয়া গাবার দিকে যাইতেছিলেন। হঠাৎ লুটেরাদের প্রতি তাঁহার দৃষ্টি পড়িল। তিনি বালক ছিলেন এবং খুব দৌঁড়াইতে পারিতেন। কথিত আছে তাঁহার দৌড় অতুলনীয় ও প্রসিদ্ধ ছিল। তিনি দৌঁড়াইয়া ঘোড়াকে ঘরিয়া ফেলিতেন কিন্তু ঘোড়া তাঁহাকে ফহরিতে পারিত না। সে সঙ্গে তীর চালনায়ও প্রসিদ্ধ ছিলেন। হযরত সালামাহ ইবনে আকওয়া রদিয়াল্লহু আ’নহু একটি পাহাড়ে আরোহণ করিয়া মাদীনার দিকে মুখ করিয়া লুটতরাজের কথা ঘোষণা করিয়া দিলেন। তীর-ধনুক ত সাথে ছিলই, স্বয়ং ঐ সকল লুটেরাদের ধাওয়া করিলেন। এমনকি তাহাদের নিকট পর্যন্ত পৌঁছিয়া গেলেন এবং তীর ছুঁড়িতে আরম্ভ করিলেন এবং এমন দ্রুত একের পর এক তীর ছুঁড়িলেন যে তাহারা ভাবিল বিরাট দল রহিয়াছে। যেহেতু তিনি একা ছিলেন এবং পায়দলও ছিলেন এইজন্য যখন কেহ ঘোড়া ফিরাইয়া তাঁহার দিকে আসিত তখন তিনি কোন গাছের আড়ালে লুকাইয়া যাইতেন এবং আড়াল হইতে তাহার ঘোড়াকে তীর মারিতেন। ইহাতে ঘোড়া আহত হইত আর সেই ব্যক্তি এই মনে করিয়া ফিরিয়া যাইত যে, যদি ঘোড়া পড়িয়া যায় তাহলে আমি ধরা পড়িয়া যাইব। হযরত সালামাহ ইবনে আকওয়া রদিয়াল্লহু আ’নহু বলেন, মোটকথা, তাহারা পালাইতে থাকিল আর আমি ধাওয়া করিতে থাকিলাম। এমনকি রসুলুল্লাহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের যে উটগুলি তাহারা লুট করিয়াছিল উহা আমার পিছনে পড়িয়া গেল। ইহা ছাড়া তাহাদের ত্রিশটি বর্শা ও ত্রিশটি চাদরও ফেলিয়া গেল। এমন সময় উয়াইনা ইবনে হিসন একটি দলসহ সাহায্যের জন্য তাহাদের নিকট পৌঁছিয়া গেল। ইহাতে তাহাদের শক্তি আরও বাড়িয়া গেল। আর ইহাও জানিতে পারিল যে, আমি একা।

তাহারা কয়েকজন মিলিয়া আমার পিছনে ধাওয়া করিল। আমি একটি পাহাড়ের উপরে উঠিয়া গেলাম। তাহারাও উঠিল। তাহারা যখন আমার নিকট আসিয়া গেল তখন আমি উচ্চস্বরে বলিলাম, একটু থাম প্রথমে আমার একটি কথা শুন। তোমরা কি আমাকে চিন আমি কে? তাহারা বলিল বল তুম কে? আমি বলিলাম, ইবনে আকওয়া। ঐ পবিত্র সত্ত্বার কসম, যিনি মুহা’ম্মাদ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামকে সম্মান দান করিয়াছেন, তোমাদের মধ্য হইতে কেহ আমাকে ধরিতে চায় তবে ধরিতে পারিবে না। আর আমি যদি তোমাদের কাহাকেও ধরিতে চাই তবে আমার হাত হইতে সে কখনও ছুটিতে পারিবে না। যেহেতু তাঁহার সম্পর্কে সাধারণ ভাবে ইহা প্রসিদ্ধ ছিল যে, তিনি খুব বেশী দৌড়াউতে পারেন। এমনকি আরবী ঘোড়াও তাঁহার মুকাবিলা করিতে পারে না। কাজেই এইরূপ দাবী কোন আশ্চর্য কিছু ছিল না। সালামাহ রদিয়াল্লহু আ’নহু বলেন, আমি এইভাবে তাহাদের সহিত কথাবার্তা বলিতে থাকি আর আমার উদ্দেশ্য ছিল তাহাদের নিকট তো সাহায্য পৌঁছিয়া গিয়াছে; মুসলমানদের পক্ষ হইতে আমার সাহায্যও আসিয়া পৌঁছুক। কারণ, আমি মাদীনায় ঘোষণা করিয়া আসিয়া ছিলাম। মোটকথা, আমি তাহাদের সহিত ঐ ভাবে কথাবার্তা বলিতে ছিলাম আর গাছের ফাঁক দিয়া মাদীনা মুনাওয়ারার দিকে গভীর দৃষ্টিতে দেখিতেছিলাম। হঠাৎ ঘোড়সওয়ারদের একটি দল দৌড়াইয়া আসিতে দেখিলাম। তাহাদের মধ্যে সকলের আগে আখরাম আসাদী রদিয়াল্লহু আ’নহু ছিলেন। তিনি আসা মাত্রই আব্দুর রহমান ফাযারীর উপর করিলেন। আব্দুর রহমানও তাঁহার উপর হামলা করিল। তিনি আব্দুর রহমানের ঘোড়ার উপর করিয়া উহার পা কটিয়া ফেলিলেন। ইহাতে ঘোড়া পড়িয়া গেল। আব্দুর রহমান পড়িতে পড়িতে তাঁহার উপর হামলা করিয়া দিল। ইহাতে তিনি শহীদ হইয়া গেলেন। আব্দুর রহমান তৎক্ষনাৎ তাঁহার ঘোড়ার উপর সওয়ার হইয়া গেল। তাঁহার পিছনে আবু কাতাদাহ রদিয়াল্লহু আ’নহু ছিলেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে আক্রমন শুরু করিয়া দিলেন। আব্দুর রহমান আবু কাতাদাহ রদিয়াল্লহু আ’নহু এর ঘোড়ার পায়ের উপর আঘাত করিল ফলে গোড়া পড়িয়া গেল এবং আবু কাতাদাহ রদিয়াল্লহু আ’নহু পড়িতে পড়িতে আব্দুর রহমানের উপর আক্রমন করিলেন, ফলে সে নিহত হইল। অতঃপর আবু কাতাদাহ রদিয়াল্লহু আ’নহু সঙ্গে সঙ্গে ঐ ঘোড়ার উপর যাহা আখ্রাম আসাদী রদিয়াল্লহু আ’নহু এর কাছে ছিল এবং এখন যাহার উপর আব্দুর রহমান সওয়ার ছিল চড়িয়া বসিলেন। (আবু দাউদ)

ফায়দাঃ কোন কোন ইতিহাস গ্রন্থে লেখা আছে যে, হযরত সালামাহ রদিয়াল্লহু আ’নহু আখরাম আসাদী রদিয়াল্লহু আ’নহু কে আক্রমন করিতে বাধাও দিয়াছিলেন যে, একটু অপেক্ষা করুন আমাদের দলের আরও লোকদের আসিতে দিন। কিন্তু তিনি বলিলেন, আমাকে শহীদ হইতে দাও। বর্ণিত আছে যে, মুসলমানদের মধ্যে একমাত্র তিনিই শাহাদাত বরণ করেন এবং কারেফদের বহু লোক এই যুদ্ধে মারা যায়। ইহার পর মুসলমানদের বিরাট দল আসিয়া পৌঁছে এবং তাহারা (কাফেররা) পালাইয়া যায়। সালামাহ রদিয়াল্লহু আ’নহু রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আবেদন করিলেন যে, আমাদের একশত লোক দিন তাহাদের ধাওয়া করিব। কিন্তু রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম ফরমাইলেন, তাহারা নিজেদের দলে পৌঁছিয়া গিয়াছে।

অধিকাংশ ইতিহাস গ্রন্থ হইতে জানা যায় যে, হযরত সালামাহ রদিয়াল্লহু আ’নহু এর বয়স তখন বার কি তের ছিল। বার-তের বছরের বালকের ঘোড় সওয়ারদের এক বিরাট দলকে এইভাবে পালাইতে বাধ্য করে যে, তাহারা দিশাহারা হইয়া পড়ে। যাহা কিছু লুঠ করিয়াছিল উহাও ছাড়িয়া যায়, এমনকি নিজেদেরও সামানপত্র ছাড়িয়া যায়। ইহা ঐ ইখলাসের বরকত ছিল যাহা আল্লহ তায়া’লা উক্ত জামাতকে দান করিয়া ছিলেন।

ফাযায়েলে আমাল (দারুল কিতাব, অক্টোবর ২০০১) পৃষ্ঠা ৮৩২-৮৩৪

বদরের যুদ্ধ এবং হযরত বারা রদিয়াল্লহু আ’নহু এর আগ্রহ

বদরের যুদ্ধ সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ এবং সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ ছিল। কেননা ইহাতে মুকাবেলা বড় কঠিন ছিল আর মুসলমানদের ছিল অতি নগণ্য। সর্বমোট তিনশত পনের জন লোক ছিলেন। যাহাদের নিকট মাত্র তিনটি ঘোড়া, ছয় অথবা নয়টি লৌহবর্ম এবং আটটি তরবারী ও সত্তরটি উট ছিল। এক একটি উটের উপর পালাক্রমে কয়েকজন সওয়ার হইতেন এবং কাফেরদের সংখ্যা প্রায় এক হাজার ছিল। যাহাদের সঙ্গে একশত ঘোড়া, সাত শত উট এবং প্রচুর পরিমাণে যুদ্ধের সামান ছিল। এইজন্য তাহারা অত্যন্ত নিশ্চিন্ত মনে বাদ্যযন্ত্র এবং গায়িকা স্ত্রী লোকদিগকে লইয়া যুদ্ধক্ষেত্রে আসিল। অপরদিকে রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম অত্যন্ত চিন্তিত ছিলেন। কেননা মুসলমানগণ খুবই দুর্বল অবস্থায় ছিলেন। রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম উভয় দলের অবস্থা অনুমান করিয়া দুআ’ করিলেন, “হে আল্লহ! এই সমস্ত মুসলমান নগ্ন পা, আপনিই ইহাদের সওয়ারী দানকারী। ইহারা বস্ত্রহীন, আপনিই ইহাদের বস্ত্রদানকারী। ইহারা ক্ষুধার্ত, আপনিই ইহাদের অন্নদানকারী। ইহারা অভাবগ্রস্থ, আপনিই ইহাদের সচ্ছলতা দানকারী।”

সুতরাং এই দুআ’ করুল হইল। এরূপ অবস্থা সত্ত্বেও হযরত আ’ব্দুল্লহ ইবনে উ’মার রদিয়াল্লহু আ’নহুমাহযরত বারা ইবনে আযেব রদিয়াল্লহু আ’নহু উভয়ে যুদ্ধে শরীক হওয়ার আগ্রহে ঘর হইতে রওয়ানা হইয়া পড়িলেন। রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম তাহাদিগকে অল্পবয়স্ক হওয়ার কারণে রাস্তা হইতে ফিরাইয়া দিলেন। (খামীস) এই উভয়জনকে উহুদের যুদ্ধ হইতেও ফিরাইয়া দেওয়া হইয়াছিল। যেমন প্রথম ঘটনায় বর্ণিত হইয়াছে। উহুদের যুদ্ধ বদরের যুদ্ধের এক বছর পরে হইয়াছে। যখন উহাতেও বাচ্চাদের মধ্যে গণ্য করা হইয়াছে সেক্ষেত্রে বদরে তো আরো বেশী বাচ্চা ছিলেন। কিন্তু তাঁহাদের অত্যন্ত আগ্রহ ছিল, কেননা ছোটবেলা হইতেই এই আগ্রহ ও চেতনা অন্তরে ঢেউ খেলিত। তাই প্রত্যেক জিহাদে শরীক হওয়ার এবং অনুমতি লাভের চেষ্টা করিতেন।

ফাযায়েলে আমাল (দারুল কিতাব, অক্টোবর ২০০১) পৃষ্ঠা ৮৩৪-৮৩৫

হযরত আ’ব্দুল্লহ রদিয়াল্লহু আ’নহু এর আপন পিতা আ’ব্দুল্লহ ইবনে উ’বাইয়ের সহিত আচরণ

৫ম হিজরীতে বনুল মুস্তালিকের বিখ্যাত যুদ্ধ সংঘটিত হয়। উহাতে একজন মুহাজির ও একজন আনসারীর মধ্যে পরস্পর লড়াই হইয়া গেল। সাধারণ বিষয় ছিল কিন্তু বড় আকার ধারণ করিল। প্রত্যেকেই নিজ নিজ কওমের নিকট অপরের বিরূদ্ধে সাহায্য চাহিল। উভয় পক্ষে দল সৃষ্টি হইয়া গেল এবং যুদ্ধ বাঁধিয়া যাওয়ার উপক্রম হইল। এমন সময়ে কিছু লোক মধ্যস্থতা করিয়া উভয় দলের মধ্যে সন্ধি করাইয়া দিলেন। আ’ব্দুল্লহ ইবনে উ’বাই মুনাফিকদের সর্দার ও অত্যন্ত প্রসিদ্ধ মুনাফিক ও মুসলমানদের ঘোরতর শত্রু ছিল কিন্তু নিজেকে মুসলমান বলিয়া প্রকাশ করিত বিধায় তাহার সহিত খারাপ আচরণ করা হইত না। আর ঐ সময় মুনাফিকদের সহিত সাধারণতঃ এই ব্যবহারই করা হইত। সে যখন এই ঘটনার খবর পাইল তখন রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের শানে বেয়াদবী মূলক উক্তি করিল এবং আপন বন্ধুদের প্রতি লক্ষ্য করিয়া বলিল, এই সমস্ত কিছু তোমাদেরই কর্মফল। তোমরা তাহাদিগকে নিজেদের শহরে স্থান দিয়াছ, নিজেদের সম্পদ সমূহ তাহাদের মধ্যে সমান ভাগে ভাগ করিয়া দিয়াছ। তোমরা যদি তাহাদের সাহায্য করা বন্ধ করিয়া দাও তবে এখনও তাহারা চলিয়া যাইবে এবং ইহাও বলিল যে, আল্লহর কসম! আমরা যদি মাদীনায় পৌঁছিয়া যাই তবে আমরা সম্মানী ব্যক্তিগণ মিলিয়া এইসব অপদস্থ লোকদের সেখান হইতে বাহির করিয়া দিব। হযরত যায়েদ ইবনে আরকাম রদিয়াল্লহু আ’নহুমা অল্পবয়স্ক বালক ছিলেন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন। ইহা শুনিয়া সহ্য করিতে পারিলেন না। তিনি বলিলেন, আল্লহর কসম! তুই অপদস্থ। তোকে তোর গোত্রের মধ্যেও তুচ্ছ দৃষ্টিতে দেখা হয়। তোর কোন সাহায্যকারী নেই। আর মুহা’ম্মাদ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম ইজ্জাত ও সম্মানের অধিকারী। রহ’মান অর্থাৎ আল্লহ তায়া’লার পক্ষ হইতেও সম্মান দান করা হইয়াছে এবং আপন গোত্রের মধ্যেও তিনি সম্মানিত।।

আ’ব্দুল্লহ ইবনে উ’বাই বলিল, আরে! চুপ থাক। আমি তো এমনিই ঠাট্টা করিয়া বলিতেছিলাম। কিন্তু হযরত যায়েদ রদিয়াল্লহু আ’নহু রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট গিয়া বলিয়া দিলেন। হযরত উ’মার রদিয়াল্লহু আ’নহু আবেদনও করিলেন যে, এই কাফেরের গর্দান উড়াইয়া দেওয়া হউক। কিন্তু রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম অনুমতি দান করিলেন না। আ’ব্দুল্লহ ইবনে উ’বাই যখন জানিতে পারিল যে, এই ঘটনা রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম পর্যন্ত পৌঁছিয়া গিয়াছে তখন সে রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের খিদমতে আসিয়া মিথ্যা কসম খাইতে লাগিল যে, আমি এইরূপ কোন শব্দ বলি নাই। যায়েদ (রদিয়াল্লহু আ’নহু) মিথ্যা কথা বলিয়াছে। আনসারদের মধ্য হইতেও কিছু লোক খিদমতে উপস্থিত ছিলেন। তাহারাও সুপারিশ করিলেন যে, ইয়া রসুলুল্লহ! আ’ব্দুল্লহ গোত্রের সর্দার ও একজন সম্মানী ব্যক্তি। একটি ছেলের কথা তাহার বিরূদ্ধে গ্রহণযোগ্য নহে, হইতে পারে ভুল শুনিয়াছে বা ভুল বুঝিয়াছে। রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম তাহার সাফাই গ্রহণ করিয়া লইলেন। হযরত যায়েদ রদিয়াল্লহু আ’নহু যখন এই কথা জানিতে পারিলেন যে, সে মিথ্যা কসম খাইয়া নিজেকে সত্যবাদী ও যায়েদকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করিয়াছে তখন লজ্জায় বাহির হওয়া বন্ধ করিয়া দিলেন। লজ্জায় রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমতেও উপস্থিত হইতে পারিলেন না।

অবশেষে সূরা মুনাফিকুন নাযিল হইল, যাহা দ্বারা হযরত যায়েদ রদিয়াল্লহু আ’নহু এর সত্যবাদিতা ও আ’ব্দুল্লহ ইবনে উ’বাইইয়ের মিথ্যা কসমের অবস্থা প্রকাশ পাইয়া গেল। পক্ষ-বিপক্ষ সকলের দৃষ্টিতে হযরত যায়েদ রদিয়াল্লহু আ’নহুয়ের মর্যাদা বৃদ্ধি পাইল এবং আ’ব্দুল্লহ ইবনে উ’বাইয়ের ঘটনাও সকলের নিকট প্রকাশ হইয়া গেল। যখন মাদীনা মুনাওয়ারা নিকটবর্তী হইল তখন আ’ব্দুল্লহ ইবনে উ’বাইয়ের পুত্র যাহার নামও আ’ব্দুল্লহ (রদিয়াল্লহু আ’নহু) ছিল এবং একজন খাঁটি মুসলমান ছিলেন। মাদীনা মুনাওয়ারার বাহিরে তরবারী উত্তোলন করিয়া দাঁড়াইয়া গেলেন এবং পিতাকে বলিতে লাগিলেন যে, ঐ সময় পর্যন্ত মাদীনা মুনাওয়ারায় প্রবেশ করিতে দিব না যতক্ষন পর্যন্ত তুমি এই কথা স্বীকার না করিবে যে, তুমিই অপদস্থ এবং মুহা’ম্মাদ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম সম্মানিত। সে আশ্চার্যন্বিত হইয়া গেল যে, এই ছেলে তো সর্বদাই পিতার সহিত অত্যন্ত সম্মানসুলভ ও উত্তম আচরণ করিত কিন্তু রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের মুকাবিলায় সহ্য করিতে পারিলেন না। অবশেষে সে বাধ্য হইয়া ইহা স্বীকার করিল যে, আল্লহর কসম আমি অপদস্থ আর মুহা’ম্মাদ (সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) সম্মানিত। ইহার পর মাদীনায় প্রবেশ করিতে পারিল।

ফাযায়েলে আমাল (দারুল কিতাব, অক্টোবর ২০০১) পৃষ্ঠা ৮৩৫-৮৩৭

হামরাউল আসাদ নামক যুদ্ধে হযরত জাবের রদিয়াল্লহু আ’নহু এর অংশ গ্রহণ

উহুদের যুদ্ধে হইতে অবসর হইয়া মুসলমানগণ মাদীনা তইয়্যেবায় পৌঁছিলেন। সফর ও যুদ্ধের ক্লান্তি যথেষ্টই ছিল। কিন্তু মাদীনা মুনাওয়ারায় পৌঁছা মাত্রই এই সংবাদ পাইলেন যে, আবু সুফিয়ান যুদ্ধ হইতে ফিরিবার পথে হামরাউল আসাদ নামক স্থানে পৌঁছিয়া সাথীদের সহিত পরমর্শ করিয়াছেন এবং এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছেন যে, উহুদের যুদ্ধে মুসলমানদের পরাজয় হইয়াছে এইরূপ সুযোগের সদ্ব্যাবহার করা উচিত ছিল। এই উদ্দেশ্যে সে পুনরায় হামলা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিল। রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোষণা করিয়া  দিয়াছিলেন যে, শুধু যাহারা উহুদের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করিয়াছে শুধু তাহারাই যাইবে এবং পুনরায় হামলা করিবার জন্য যাইতে হইবে। যদিও মুসলমানগণ ক্লান্ত পরিশ্রান্ত ছিলেন কিন্তু ইহা সত্ত্বেও সকলেই প্রস্তুত হইয়া গেলেন। যেহেতু রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোষণা দিয়াছিলেন যে, শুধু যাহারা উহুদের যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করিয়াছে তাহারাই যাইবে তাই জাবের রদিয়াল্লহু আ’নহু আবেদন করিলেন, ইয়া রসুলুল্লহ! আমার উহুদের যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করিবার আকাঙ্খা ছিল কিন্তু আমার পিতা এই বলিয়া অনুমতি দেন নাই যে, আমার সাতটি বোন রহিয়াছে অন্য কোন পুরুষ নাই। তিনি বলিয়াছিলেন যে, আমাদের মধ্য হইতে একজনকে অবশ্যই থাকিতে হইবে। আর তিনি নিজে যাওয়ার সিদ্ধান্ত লইয়া ফেলিয়াছিলেন, এই কারণে আমাকে অনুমতি দিয়াছিলেন না। উহুদের যুদ্ধে তিনি শহীদ হইয়া গিয়াছেন। এখন আমাকে আপনার সহিত যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি দান করুন। রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম অনুমতি দান করিলেন। তিনি ব্যতীত এমন আর কোন সাহাবী যান নাই যিনি উহুদের যুদ্ধে শরীক হন নাই। (খামীস)

ফায়দাঃ হযরত জাবের রদিয়াল্লহু আ’নহু এর এমন আগ্রহ ও আকাঙ্ক্ষা সহকারে অনুমতি চাওয়া কতই না ঈর্ষাযোগ্য যে, মাত্র পিতার ইন্তেকাল হইয়াছে। পিতার জিম্মায় করজও অনেক বেশী। তাহাও আবার ইয়াহুদীদের হইতে লওয়া হইয়াছিল যে অত্যন্ত কঠোর আচরণ করিত এবং বিশেষভাবে তাহার সহিত কঠোর ব্যবহার করিতেছিল। ইহা ছাড়াও বোনদের ভরণ পোষণের চিন্তা, কেননা পিতা সাতটি বোনও রাখিয়া গিয়াছেন। যাহাদের কারণে পিতা তাহাকে উহুদের যুদ্ধে অংশ গ্রহণের অনুমতিও দিয়াছিলেন না। যাহাদের কারণে উহুদের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করিতে পারেন নাই। কিন্তু এই সবকিছুর উপর জিহাদের প্রেরণা ছিল প্রবল।

ফাযায়েলে আমাল (দারুল কিতাব, অক্টোবর ২০০১) পৃষ্ঠা ৮৩৭-৮৩৮