Posts Tagged ‘সুরা তওবা’

সাহাবাহ কেরাম রদিয়াল্লহু আ’নহুমদের মুহাব্বাতের বিভিন্ন ঘটনা

হযরত আ’লী রদিয়াল্লহু আ’নহু এর নিকট কেহ জিজ্ঞাসা করিল, রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের সহিত আপনার মুহাব্বাত কি পরিমাণ ছিল? হযরত আ’লী রদিয়াল্লহু আ’নহু বলিলেন, আল্লহর কসম, রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের নিকট আমাদের ধন-সম্পদ হইতে, আমাদের সন্তান-সন্ততি হইতে, আমাদের মাতাগণ হইতে এবং কঠিন পিপাসা অবস্থায় ঠান্ডা পানি হইতেও অধিক প্রিয় ছিলেন।

ফায়দাঃ সত্য বলিয়াছেন। বাস্তবে সাহাবাহ কেরাম রদিয়াল্লহু আ’নহুমদের  এই অবস্থাই ছিল। আর হইবেই না কেন? তাঁহারা পরিপূর্ণ ঈমানের অধিকারী ছিলেন, আল্লহ তায়া’লা এরশাদ করিয়াছেন–

قُلْ إِن كَانَ آبَاؤُكُمْ وَأَبْنَاؤُكُمْ وَإِخْوَانُكُمْ وَأَزْوَاجُكُمْ وَعَشِيرَتُكُمْ وَأَمْوَالٌ اقْتَرَفْتُمُوهَا وَتِجَارَةٌ تَخْشَوْنَ كَسَادَهَا وَمَسَاكِنُ تَرْضَوْنَهَا أَحَبَّ إِلَيْكُم مِّنَ اللَّـهِ وَرَسُولِهِ وَجِهَادٍ فِي سَبِيلِهِ فَتَرَبَّصُوا حَتَّىٰ يَأْتِيَ اللَّـهُ بِأَمْرِهِ ۗ وَاللَّـهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِينَ

অর্থঃ আপনি তাহাদিগকে বলিয়া দিন যদি তোমাদের পিতা, তোমাদের পুত্র, তোমাদের ভাই, তোমাদের স্ত্রীগণ, তোমাদের আত্মীয়-স্বজন আর ঐ ধন-সম্পদ যাহা তোমরা উপার্জন করিয়াছ, আর ঐ ব্যবসা যাহার মধ্যে তোমরা লোকসানের আশংকা কর আর ঐ ঘরবাড়ী যাহা তোমরা ভালবাস যদি (এইসব কিছু) তোমাদের কাছে আল্লহ তায়া’লা এবং তাঁহার রসূল ও তাঁহার পথে জিহাদ করার চাইতে অধিক প্রিয় হয়, তবে তোমরা আল্লহ তায়া’লার নির্দেশের অপেক্ষা কর। আর আল্লহ তায়া’লা অবাধ্য লোকদিগকে তাহাদের মকসুদ পর্যন্ত পৌঁছান না। (সুরা তওবাহঃ ২৪ – বয়ানুল কুরআন)

উক্ত আয়াতে আল্লহ তায়া’লা ও তাঁহার রসূলের মুহাব্বাত এই সমস্ত জিনিস হইতে কম হওয়ার ব্যাপারে ভয় দেখানো হইয়াছে।

হযরত আনাস রদিয়াল্লহু আ’নহু বলেন, রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম ফরমাইয়াছেন,  তোমাদের মধ্যে কেহ ঐ পর্যন্ত মুমিন হইতে পারিবে না যতক্ষন পর্যন্ত তাহার নিকট আমার মুহাব্বাত ও ভালবাসা তাহার পিতা, সন্তান-সন্ততি এবং সমস্ত মানুষ হইতে বেশি না হইবে।

হযরত আবু হুরইরহ রদিয়াল্লহু আ’নহু হইতেও অনুরূপ বিষয় বর্ণিত হইয়াছে।

উলামা কেরাম বলেন, উপরোক্ত হাদীসে মুহাব্বাত দ্বারা এখতিয়ারী মুহাব্বাত অর্থাৎ ইচ্ছাকৃত মুহাব্বাত বুঝানো হইয়াছে। গায়ের এখতিয়ারী মুহাব্বাত অর্থাৎ স্বভাবসুলভ বা অনিচ্ছাকৃত মুহাব্বাত এখানে উদ্দেশ্য নহে। ইহাও হইতে পারে যে,  যদি স্বভাবসুলভ মুহাব্বাত উদ্দেশ্য হয় তবে ঈমান দ্বারা পরিপূর্ণ দরজার ঈমান উদ্দেশ্য হইবে–যেমন সাহাবাহ কেরামদের মধ্যে ছিল।

হযরত আনাস রদিয়াল্লহু আ’নহু বর্ণনা করেন, রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম ফরমাইয়াছেন, তিনিটি বস্তু এমন যে ব্যক্তির মধ্যে উহা পাওয়া যাইবে ঈমানের স্বাদ ও ঈমানের মজা তাহার নসীব হইয়া যাইবে। এক) আল্লহ তায়া’লা ও তাঁহার রসূলের মুহাব্বাত সমস্ত জিনিস হইতে বেশি হইবে। দুই) কাহাকেও ভালবাসিলে আল্লহ তায়া’লার উদ্দেশ্যেই ভালবাসিবে। তিন) কুফরের দিকে ফিরিয়া যাওয়া তাহার কাছে এমন কষ্টকর ও মুশকিল মনে হয় যেমন আগুনে পতিত হওয়া।

হযরত উ’মার রদিয়াল্লহু আ’নহু একবার আরজ করিলেন, ইয়া রসুলুল্লহ! আপনি আমার নিকট আমার জান ব্যতীত অন্য সমস্ত বস্তু হইতে বেশি প্রিয়। রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলিলেন, কোন ব্যক্তি ঐ পর্যন্ত মুমিন হইতে পারিবে না যতক্ষন আমার মুহাব্বাত তাহার নিকট তাহার জানের চাইতেও বেশি না হইবে। হযরত উ’মার রদিয়াল্লহু আ’নহু বলিলেন, ইয়া রসুলুল্লহ! আপনি আমার নিকট আমার জানের চাইতেও বেশি প্রিয়। তখন রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলিলেন, এখন হে উ’মার

আলেমগণ এই কথার দুইটি অর্থ বলিয়াছেন। একটি হইল এখন তোমার ঈমান পরিপূর্ণ হইয়াছে। অপরটি হইল সতর্ক করা হইয়াছে অর্থাৎ এতক্ষনে তোমার মধ্যে এই জিনিস পয়দা হইয়াছে যে, আমি তোমার নিকট তোমার প্রাণের চেয়েও বেশী প্রিয়, তথচ ইহা তো প্রথম হইতেই হওয়া উচিত ছিল।

সুহাইল তুস্তারী রহমাতুল্লহ আ’লাইহি বলেন, যে ব্যক্তি সর্বস্থায় রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামকে নিজের অভিভাবক মনে না করে এবং নিজের নফসকে নিজের মালিকানায় মনে করে যে সুন্নতের স্বাদ পাইতে পারে না।

এক সাহাবী রদিয়াল্লহু আ’নহু রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট আসিয়া আরজ করিলেন, ইয়া রসুলুল্লহ! কিয়ামাত কখন আসিবে? রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলিলেন, কিয়ামাতের জন্য কি প্রস্তুতি গ্রহণ করিয়াছ, যে উহার জন্য অপেক্ষা করিতেছ? তিনি আরজ করিলেন, ইয়া রসুলুল্লহ! আমি অধিক পরিমাণ নামায, রোযা ও সদকা তো তৈয়ার করিয়া রাখি নাই, তবে আল্লহ তায়া’লা ও তাঁহার রসূলের মুহাব্বাত আমার অন্তরে রহিয়াছে। রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলিলেন, কিয়ামাতের দিন তুমি তাহারই সহিত থাকিবে যাহার সহিত মুহাব্বাত রাখিয়াছ।

রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের এরশাদ, মানুষের হাশর তাহারই সহিত হইবে যাহার সহিত তাহার মুহাব্বাত রহিয়াছে। এই হাদীস কয়েক জন সাহাবী বর্ণনা করিয়াছেন তন্মধ্যে আ’ব্দুল্লহ ইবনে মাসউদ, আবু মূসা আশআরী, সাফওয়ান, আবুযার রদিয়াল্লহু আ’নহুম প্রমুখ রহিয়াছেন।

হযরত আনাস রদিয়াল্লহু আ’নহু বলেন, সাহাবাহ কেরাম রদিয়াল্লহু আ’নহুম এর এরশাদ শুনিয়া যত খুশি হইয়াছিলেন আর কোন কিছুতেই এত খুশি হন নাই। আর ইহা স্পষ্ট বিষয় যে, এরূপ হওয়াটাই সাভাবিক ছিল। কেননা রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের মুহাব্বাত তো তাহাদের শিরা-উপশিরায় গাঁথা ছিল। সুতরাং তাঁহারা কেন খুশি হইবেন না।

হযরত ফাতিমা রদিয়াল্লহু আ’নহা এর ঘর প্রথমে রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট হইতে এ্কটু দূরে ছিল। একবার রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলিলেন, আমার মনে চাহিতেছিল যে, তোমার ঘর যদি একেবারে নিকটে হইত। হযরত ফাতিমা রদিয়াল্লহু আ’নহা আরজ করিলেন, হারেছা রদিয়াল্লহু আ’নহু এর ঘর আপনার নিকটে। তাঁহাকে বলিয়া দিন, তিনি যেন আমার ঘরের সহিত বিনিময় করিয়া লন। রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলিলেন, তাহার সহিত আগেও বিনিময় হইয়াছে এখন তো লজ্জা হইতেছে। হারেছা রদিয়াল্লহু আ’নহু এই সংবাদ পাইয়া তৎক্ষনাৎ উপস্থিত হইয়া আরজ করিলেন, ইয়া রসুলুল্লহ! আমি জানিতে পারিয়াছি আপনি ফাতিমা রদিয়াল্লহু আ’নহা এর ঘর আপনার নিকটে হওয়া চাহিতেছেন। এইগুলি আমার ঘর এইগুলি হইতে নিকটবর্তী আর কোন ঘর নাই। যেই ঘরটি পছন্দ হয় বিনিময় করিয়া নিন। ইয়া রসুলুল্লহ! আমি এবং আমার মাল তো আল্লহ তায়া’লা ও তাঁহার রসূলের জন্যই। ইয়া রসুলুল্লহ! আল্লহর কসম, আপনি যে মাল নিয়া নিবেন উহা আমার নিকট বেশি পছন্দনীয় ঐ মাল হইতে যাহা আমার নিকট থাকিয়া যাইবে। রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলিলেন, তুমি সত্য বলিয়াছ। অতঃপর তাঁহার জন্য বরকতের দুআ করিলেন এবং ঘর বিনিময় করিয়া লইলেন। (তাবাকাত)

ফাযায়েলে আমাল (দারুল কিতাব, অক্টোবর ২০০১) পৃষ্ঠা ৮৬৪-৮৬৭

সাহাবাহ কেরাম রদিয়াল্লহু আ’নহুমদের সহিত ব্যবহার ও তাঁহাদের সংক্ষিপ্ত গুণাবলী

সাহাবাহ কেরাম রদিয়াল্লহু আ’নহুমদের কয়েকটি ঘটনা নমুনা স্বরূপ লেখা হইয়াছে, নতুবা তাঁহাদের অবস্থা বড় বড় কিতাবেও সংকুলান হইবে না। উর্দুতে এই বিষয়ের উপর যথেষ্ট কিতাবাদী পাওয়া যায়। কয়েকটি মাস হইল এই কিতাবটি লিখিতে শুরু করিয়াছিলাম, কিন্তু মাদ্রাসার ব্যস্ততার এবং অন্যান্য সাময়িক অসুবিধার কারণে বাধাগ্রস্থ হইয়াছি। এখন এই কয়েকটি পৃষ্ঠা লিখিয়াই শেষ করিতেছি, যেন যাহা লেখা হইয়াছে তাহা উপকারী হয়।

পরিশেষে একটি গুরুত্বপুর্ণ বিষয় সম্পর্কে সতর্ক করা জরুরী মনে করিতেছি। আর তাহা এই যে, এই উচ্ছৃঙ্খলতার যুগে যেই ক্ষেত্রে আমাদের মুসলমানদের মধ্যে দ্বীনের অন্যান্য বহু বিষয়ে ত্রুটি-বিচ্যুতি এবং উপেক্ষা পরিলক্ষিত হইতেছে সেইক্ষেত্রে সাহাবাহ কেরাম রদিয়াল্লহু আ’নহুমদের হক এবং তাঁহাদের আদাব এহতেরামের ব্যাপারেও সীমাহীন ত্রুটি হইতেছে। বরং ইহা অপেক্ষাও মারাত্মক হইল দ্বীনের ব্যাপারে উদাসীন কিছু লোক তো তাঁহাদের শানে বেয়াদবী পর্যন্ত করিয়া বসে। অথচ সাহাবাহ কেরাম রদিয়াল্লহু আ’নহুম হইলেন দ্বীনের বুনিয়াদ। সর্বপ্রথম তাঁহারাই দ্বীনের প্রচার-প্রসার করিয়াছেন। সারা জীবন চেষ্টা করিয়াও আমরা তাহাদের হক আদায় করিতে পারিব না। আল্লহ তায়া’লা আপন অনুগ্রহে তাঁহাদের প্রতি লাখো রহমত নাযিল করুন। কেননা তাঁহার রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের কাছ থেকে দ্বীন হাসিল করিয়া আমাদের পর্যন্ত পৌঁছাইয়াছেন। তাই এই কিতাবে কাযী ইয়ায রহমাতুল্লহ আ’লাইহি এর শিফা নামক কিতাবের একটি পরিচ্ছেদের সংক্ষিপ্ত তরজমা যাহা এই ক্ষেত্রে উপযোগী, উল্লেখ করিতেছি এবং ইহার উপরেই এই পুস্তিকা সমাপ্ত করিতেছি।

তিনি বলেন, রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি ভক্তি ও সম্মান প্রদর্শনেরই অন্তর্ভূক্ত হইতেছে তাঁহার সাহাবাহ রদিয়াল্লহু আ’নহুমগণের সম্মান করা, তাঁহাদের হক জানা, তাঁহাদের অনুসরণ করা, তাঁহাদের প্রশংসা করা, তাঁহাদের জন্য মাগফেরাতের দোয়া করা, তাঁহাদের পারস্পরিক মতানৈক্য সম্পর্কে আলোচনা না করা। ঐতিহাসিক, শিয়া, বিদয়াতী এবং জাহেল বর্ণনাকারীদের ঐ সমস্ত বর্ণনার প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করা, যাহা তাঁহাদের সম্পর্কে অবমাননাকর। যদি এই ধরণের কোন বর্ণনা কানে আসে তবে উহার কোন ভাল ব্যাখ্যা করিবে এবং কোন ভাল অর্থ নির্ধারণ করিবে যাহা তাঁহাদের শানের উপযোগী হয়। তাঁহাদের কোন দোষ বর্ণনা করিবে না। বরং তাঁহাদের গুণাবলী বর্ণনা করিবে এবং দোষনীয় বিষয়ে নিরবতা অবলম্বন করিবে। যেমন রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করিয়াছেন, যখন আমার সাহাবীদের (মন্দ) আলোচনা হয় তখন চুপ থাক।

সাহাবাহ কেরাম রদিয়াল্লহু আ’নহুমদের মর্যাদার কথা কুরআন ও হাদিসে অধিক পরিমাণে বর্ণিত হইয়াছে। আল্লহ তায়া’লা এরশাদ করেন–

مُّحَمَّدٌ رَّسُولُ اللَّـهِ ۚ وَالَّذِينَ مَعَهُ أَشِدَّاءُ عَلَى الْكُفَّارِ رُحَمَاءُ بَيْنَهُمْ ۖ تَرَاهُمْ رُكَّعًا سُجَّدًا يَبْتَغُونَ فَضْلًا مِّنَ اللَّـهِ وَرِضْوَانًا ۖ سِيمَاهُمْ فِي وُجُوهِهِم مِّنْ أَثَرِ السُّجُودِ ۚ ذَٰلِكَ مَثَلُهُمْ فِي التَّوْرَاةِ ۚ وَمَثَلُهُمْ فِي الْإِنجِيلِ كَزَرْعٍ أَخْرَجَ شَطْأَهُ فَآزَرَهُ فَاسْتَغْلَظَ فَاسْتَوَىٰ عَلَىٰ سُوقِهِ يُعْجِبُ الزُّرَّاعَ لِيَغِيظَ بِهِمُ الْكُفَّارَ ۗ وَعَدَ اللَّـهُ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ مِنْهُم مَّغْفِرَةً وَأَجْرًا عَظِيمًا

অর্থঃ মুহাম্মাদ আল্লহর রসূল আর যাহারা তাঁহার সঙ্গে আছে তাহারা কাফিরদের মোকাবেলায় অত্যন্ত কঠোর আর পরস্পরে সদয়। হে শ্রোতা! তুমি তাহাদিগকে দেখিতে পাইবে তাহারা কখনও রুকু অবস্থায় আছে কখনও সিজদারত আছে এবং আল্লহ তায়া’লার অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টির তালাশে লিপ্ত রহিয়াছে। তাহাদের বন্দেগীর আলামত তাঁহাদের চেহারার উপর সিজদার কারণে পরিস্ফুট হইয়া আছে। তাঁহাদের এই সবগুণ তাওরাতে রহিয়াছে আর ইঞ্জিলে তাঁহাদের এই দৃষ্টান্ত বর্ণনা করা হইয়াছে, যেমন শস্য যাহা প্রথমে আপন অঙ্কুর বাহির করিল, অতঃপর উহা আপন অঙ্কুরকে শক্তিশালী করিল, অর্থাৎ উক্ত শস্য মোটা তাজা হইল। তারপর উহা আরও মোটা-তাজা হইল অতঃপর আপন কান্ডের উপর সোজা দাঁড়াইয়া গেল, ফলে কৃষকের আনন্দবোধ হইতে লাগিল। (তদ্রূপ সাহাবাহ রদিয়াল্লহু আ’নহুমদের মধ্যে প্রথমে দুর্বলতা ছিল, অতঃপর দিন দিন তাঁহাদের শক্তি বৃদ্ধি পাইল। আল্লহ তায়া’লা সাহাবাহদের এইরূপ ক্রমোন্নতি দান করিলেন) যেন কাফেরদিগকে হিংসার আগুনে বিদগ্ধ করেন। আর আখেরাতে আল্লহ তায়া’লা ঐ সকল ব্যক্তিদের সহিত যাহারা ঈমান আনিয়াছে এবং নেক আমাল করিতেছে ক্ষমা এবং বিরাট প্রতিদানের ওয়াদা করিয়া করিয়াছেন। (সূরা ফাতহঃ ২৯)

তাওরাত শব্দের উপর যদি আয়াত শেষ হয় তবে এরূপ তরজমা হইবে যাহা উপরে করা হইয়াছে।আর আয়াতের পার্থক্যের কারণে অর্থেও পার্থক্য হইয়া যাইবে, যাহা তাফসীরের কিতাব সমূহ হইতে বুঝা যাইতে পারে। উক্ত সূরারই অপর জায়গায় এরশাদ হইয়াছে–

لَّقَدْ رَضِيَ اللَّـهُ عَنِ الْمُؤْمِنِينَ إِذْ يُبَايِعُونَكَ تَحْتَ الشَّجَرَةِ فَعَلِمَ مَا فِي قُلُوبِهِمْ فَأَنزَلَ السَّكِينَةَ عَلَيْهِمْ وَأَثَابَهُمْ فَتْحًا قَرِيبًا

অর্থঃ নিশ্চয়ই আল্লহ তায়া’লা ঐ সকল মুসলমানদের প্রতি সন্তুষ্ট হইয়াছেন (যাহারা আপনার সফর সঙ্গী), যখন তাঁহারা আপনার সহিত গাছের নিচে অঙ্গীকার করিতেছিল এবং তাঁহাদের অন্তরে যাহা কিছু (ইখলাস ও মজবুতি) ছিল উহাও আল্লহ তায়া’লার জানা ছিল, আর আল্লহ তায়া’লা তাঁহাদের অন্তরে প্রশান্তি সৃষ্টি করিয়া দিয়াছিলেন এবং তাহাদিগকে একটি নিকটবর্তী বিজয় দান করিলেন। (ইহা দ্বারা খায়বরের বিজয় কে বুঝানো হইয়াছে, যাহা উহার একেবারে নিকটবর্তী সময়ে হইয়াছে) আর প্রচুর গনিমতও দান করিলেন। আল্লহ তায়া’লা বড় যবরদস্ত হিকমাতওয়ালা। (সূরা ফাতহঃ ১৮)

সাহাবাহ কেরাম রদিয়াল্লহু আ’নহুমদের ব্যাপারে আল্লহ তায়া’লা এরশাদ করেন–

مِّنَ الْمُؤْمِنِينَ رِجَالٌ صَدَقُوا مَا عَاهَدُوا اللَّـهَ عَلَيْهِ ۖ فَمِنْهُم مَّن قَضَىٰ نَحْبَهُ وَمِنْهُم مَّن يَنتَظِرُ ۖ وَمَا بَدَّلُوا تَبْدِيلًا

অর্থঃ ঐ সকল মুমিনদের মধ্যে কিছু লোক এমন রহিয়াছে যাহারা আল্লহর সহিত যে ওয়াদা করিয়াছিল উহাতে সত্য প্রমানিত হইয়াছে। অতঃপর তাহাদের মধ্যে কিছু লোক এমন রহিয়াছে যাহারা আপন মানত পূর্ণ করিয়াছে (অর্থাৎ শহীদ হইয়া গিয়াছে।) আর কিছু তাহাদের মধ্য হইতে উহার জন্য আগ্রহী এবং অপেক্ষায় আছে (এখনও শহীদ হয় নাই) এবং নিজেদের ইচ্ছার মধ্যে  কোনরূপ পরিবর্তন ও রদ-বদল ঘটায় নাই। (সূরা আহযাবঃ ২৩)

এক জায়গায় আল্লহ তায়া’লা এরশাদ করিয়াছেন–

وَالسَّابِقُونَ الْأَوَّلُونَ مِنَ الْمُهَاجِرِينَ وَالْأَنصَارِ وَالَّذِينَ اتَّبَعُوهُم بِإِحْسَانٍ رَّضِيَ اللَّـهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ وَأَعَدَّ لَهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي تَحْتَهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا ۚ ذَٰلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ

অর্থঃ যে সমস্ত মুহাজির এবং আনসারগণ (ঈমান আনয়নের ক্ষেত্রে সকল উম্মত হইতে) অগ্রবর্তী আর যে সকল লোক ইখলাসের সহিত তাঁহাদের অনুগামী হইয়াছে, আল্লহ তায়া’লা তাহাদের সকলের প্রতি সন্তুষ্ট হইয়াছেন আর তাহারা সকলে আল্লহ তায়া’লার প্রতি সন্তুষ্ট হইয়াছে আর আল্লহ তায়া’লা এমন বাগান সমূহ তৈয়ার করিয়া রাখিয়াছেন যেইগুলির তলদেশ দিয়া নহর প্রবাহিত হইবে যাহাতে তাহারা চিরকাল থাকিবে এবং ইহা বড় কামিয়াবী। (সূরা তওবাহঃ ১০০)

উল্লেখিত আয়াতসমূহে আল্লহ তায়া’লা সাহাবাহ কেরাম রদিয়াল্লহু আ’নহুমদের প্রশংসা এবং তাঁহাদের প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশ করিয়াছেন।

অনুরূপ ভাবে বিভিন্ন হাদীসেও অত্যধিক পরিমাণে তাঁহাদের গুণাবলী বর্ণিত হইয়াছে। রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম ফরমাইয়াছেন আমার পর আবু বকর রদিয়াল্লহু আ’নহুউ’মার রদিয়াল্লহু আ’নহু এর অনুসরণ করিও। এক হাদীসে এরশাদ করিয়াছেন, আমার সাহবাহগণ তারকার ন্যায়, তোমরা যাহারই অনুসরণ করিবে হেদায়াত প্রাপ্ত হইবে।

উল্লেখিত হাদীস সম্পর্কে মুহাদ্দিসগণে আপত্তি রহিয়াছে। এইজন্যই কাযী ইয়ায রহমাতুল্লহ আ’লাইহি উক্ত হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন বলিয়া তাঁহার উপর প্রশ্ন তোলা হইয়াছে। তবে মোল্লা আ’লী ক্বারী রহমাতুল্লহ আ’লাইহি লিখিয়াছেন, হইতে পারে একাধিক সনদের মাধ্যমে বর্ণিত হওয়ার কারণে উক্ত হাদীস তাঁহার নিকট নির্ভরযোগ্য অথবা ফযীলত ও মর্যাদার সম্পর্কিত হওয়ার কারণে তিনি উল্লেখ করিয়াছেন। (কেননা ফযীলতের হাদীস সামান্য দুর্বলতা সত্ত্বেও উল্লেখ করা হইয়া থাকে।)

হযরত আনাস রদিয়াল্লহু আ’নহু বলেন, রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম ফরমাইয়াছেন, আমার সাহাবীদের দৃষ্টান্ত হইল খাদ্যের মধ্যে লবনের ন্যায় যেমন খাদ্য লবন ব্যতীত সুস্বাদু হইতে পারে না।

রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম ইহাও এরশাদ করিয়াছেন, আমার সাহাবীগনের ব্যাপারে আল্লহ কে ভয় কর। তাঁহাদিগকে সমালোচনার পাত্র বানাইও না। যে ব্যক্তি তাঁহাদের প্রতি মুহাব্বাত রাখে, আমার মুহাব্বাতের কারণেই তাঁহাদের প্রতি মুহাব্বাত রাখে। আর যে ব্যক্তি তাঁহাদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে যে আমার প্রতি বিদ্বেষ পোষণের কারণেই তাঁহাদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে। যে তাঁহাদিগকে কষ্ট দিল সে আমাকে কষ্ট দিল, আর যে আমাকে কষ্ট দিল সে আল্লহকে কষ্ট দিল। আর যে আল্লহকে কষ্ট দেয় সে অতিসত্বর পাকড়াও হবে।

রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম ইহাও এরশাদ করিয়াছেন যে, আমার সাহাবীগণকে গালি দিও না। তোমাদের কেহ যদি উহুদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণ খরচ করে তবে উহা সওয়াবের দিক হইতে সাহাবাদের এক মুদ বা আধা মুদের সমান হইতে পারে না। (এক মুদ প্রায় এক সেরের সমান)

রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করিয়াছেন যে ব্যক্তি সাহাবাহদিগকে গালি দিবে তাহার উপর আল্লহ তায়া’লার লানত, ফেরেশতাদের লানত এবং সমস্ত মানুষের লানত। তাহার না ফরয কবুল হইবে না নফল।

রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করিয়াছেন, আল্লহ তায়া’লা নবীগণ ব্যতীত অন্য সমস্ত মানুষ হইতে আমার সাহাবীদিগকে বাছাই করিয়াছেন। তাঁহাদের মধ্য হইতে চারজনকে স্বাতন্ত্র্য দান করিয়াছেন–আবু বকর, উ’মার, উ’সমান, আ’লী রদিয়াল্লহু আ’নহুম। তাঁহাদিগকে আমার সাহাবীগণের মধ্যে শেষ্ঠ সাব্যস্ত করিয়াছেন।

আইয়ূব সাখতিয়ানী রহমাতুল্লহ আ’লাইহি বলেন, যে ব্যক্তি আবু বকর রদিয়াল্লহু আ’নহু কে ভালবাসিল সে দ্বীনকে সোজা করিল, যে ব্যক্তি উ’মার রদিয়াল্লহু আ’নহু কে ভালবাসিল সে দ্বীনের সুস্পষ্ট রাস্তা পাইল, যে উ’সমান রদিয়াল্লহু আ’নহু কে ভালবাসিল সে আল্লহ তায়া’লার নূর দ্বারা আলোকিত হইল আর যে আ’লী রদিয়াল্লহু আ’নহু কে ভালবাসিল সে দ্বীনের মজবুত রশি ধারণ করিল। যে সাহাবাহ দের প্রশংসা করিল সে মুনাফিকী হইতে মুক্ত আর যে সাহাবাহ দের সহিত বেয়াদবী করে সে বিদয়াতী, মুনাফিক ও সুন্নত বিরোধী। আমার আশংকা হয় যে তাহার কোন আমাল কবুল হইবে না, যে পর্যন্ত তাঁহাদের সকলের প্রতি মুহাব্বাত না রাখিবে এবং তাঁহাদের সম্পর্কে দিল সাফ না হইবে।

এক হাদীসে আছে, রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন, হে লোকেরা! আমি আবু বকরের প্রতি সন্তুষ্ট তোমরা তাঁহার মর্যাদা বুঝিও। আমি উ’মার, আ’লী, উ’সমান, তলহা, যুবাইর, সা’দ, সাঈ’দ, আবদুর রহমান ইবনে আওফ এবং আবু উ’বাইদাহ রদিয়াল্লহু আ’নহুম এর প্রতি সন্তুষ্ট তোমরা তাঁহাদের মর্যাদা বুঝিও। হে লোকেরা! আল্লহ তায়া’লা বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদিগকে এবং হুদায়বিয়ার যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদিগকে ক্ষমা করিয়া দিয়াছেন। তোমরা আমার সাহাবীদের ব্যাপারে আমার প্রতি লক্ষ্য রাখিবে আর ঐ সমস্ত লোকদের ব্যাপারে যাহাদের কন্যারা আমার বিবাহের মধ্যে আছে এবং আমার কন্যারা যাহাদের বিবাহের মধ্যে আছে। এমন যেন না হয় যে, তাঁহারা তোমাদের বিরুদ্ধে কিয়ামাতের দিন জুলুমের অভিযোগ করিয়া বসে। কেননা উহা মাফ করা হইবে না।

এক জায়গায় এরশাদ করিয়াছেন, আমার সাহাবী এবং আমার জামাতাদের ব্যাপারে আমার দিকে খেয়াল রাখিও। যে ব্যক্তি তাঁহাদের ব্যাপারে আমার প্রতি খেয়াল করিবে আল্লহ তায়া’লা তাহাকে দুনিয়া আখেরাতে হিফাযত করিবেন আর যে ব্যক্তি তাঁহাদের ব্যাপারে আমার প্রতি খেয়াল করিবে না আল্লহ তায়া’লা তাহার দায়িত্ব হইতে মুক্ত, অসম্ভব নয় যে সে কোন আযাবে পাকড়াও হইয়া যাইবে।

রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম হইতে ইহাও বর্ণিত আছে যে, যে ব্যক্তি সাহাবীদের ব্যাপারে আমার খেয়াল করিবে কিয়ামাতের দিন আমি তাহার হিফাযতকারী হইব।

এক জায়গায় এরশাদ করিয়াছেন, যে ব্যক্তি আমার সাহাবীদের ব্যাপারে আমার খেয়াল করিবে সে আমার নিকট হাউজে কাউসারে পৌঁছিতে পারিবে আর যে আমার সাহাবীদের ব্যাপারে আমার খেয়াল করিবে না সে আমার নিকট হাউজ পর্যন্ত পৌঁছিতে পারিবে না এবং দূর হইতে শুধু দেখিতে হইবে।

সাহল ইবনে আ’ব্দুল্লহ রহমাতুল্লহ আ’লাইহি বলেন, যে ব্যক্তি রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবীদের সম্মান করে না সে রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি ঈমানই আনে নাই।

আল্লহ তায়া’লা আপন অনুগ্রহে তাঁহার শাস্তি এবং আপন মাহবুবের অসন্তুষ্টি হইতে আমাকে, আমার বন্ধু-বান্ধবকে, আমার হিতাকাঙ্খীদেরকে, আমার সহিত সাক্ষাতকারীদেরকে, আমার শাইখ ও ছাত্রদিগকে ও সমস্ত মুমিনে-মুসলমানদিগকে রক্ষা করুন এবং আমাদের অন্তরসমূহকে সাহাবাহ কেরাম রদিয়াল্লহু আ’নহুম দের মুহাব্বাত দ্বারা পরিপূর্ণ করিয়া দিন—আমীন।

যাকারিয়া উফিয়া আ’নহু
মুকীম, মাদ্রাসা মাযাহেরে উলুম, সাহারানপুর
১২ই শাওয়াল, ১৩৫৭ হিঃ, সোমবার।

ফাযায়েলে আমাল (দারুল কিতাব, অক্টোবর ২০০১) পৃষ্ঠা ৮৭১-৮৭৬