Posts Tagged ‘রাসুলের মুহাব্বত’

সাহাবাহ কেরাম রদিয়াল্লহু আ’নহুমদের মুহাব্বাতের বিভিন্ন ঘটনা (বিশেষ দ্রষ্টব্য)

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ উলামা কেরাম রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি মুহাব্বাত ও ভালবাসার বিভিন্ন আলামত উল্লেখ করিয়াছেন। কাযী ইয়ায রহমাতুল্লহ আ’লাইহি বলেন, যে ব্যক্তি কোন বস্তুকে মুহাব্বাত করে সে উহাকে অন্য সব কিছুর উপরে প্রাধান্য দেয়। মুহাব্বাতের অর্থ ইহাই। এইরূপ না হইলে উহা মুহাব্বাত নহে বরং মুহাব্বাতের দাবী মাত্র। অতএব রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের সহিত মুহাব্বাতের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ আলামত হইল তাঁহার অনুসরণ করা, তাঁহার তরীকা অবলম্বন করা এবং তাঁহার কথা ও কাজ অনুযায়ী চলা, তাঁহার হুকুম সমুহ পালন করা, তিনি যেসব বিষয় হইতে বিরত থাকিতে বলিয়াছেন উহা হইতে বিরত থাকা। সুখে-দুঃখে, অভাবে-স্বচ্ছলতায় সর্বাবস্থায় তাঁহার তরীকার উপর চলা। কুরআন পাকে এরশাদ হইয়াছে–

قُلْ إِن كُنتُمْ تُحِبُّونَ اللَّـهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللَّـهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ ۗ وَاللَّـهُ غَفُورٌ رَّحِيمٌ

অর্থঃ আপনি তাহাদিগকে বলিয়া দিন, তোমরা যদি আল্লহ তায়া’লাকে ভালবাসিয়া থাক তবে তোমরা আমার অনুসরণ কর, আল্লহ তায়া’লা তোমাদিগকে ভালবাসিবেন এবং তোমাদের গুনাহ মাফ করিয়া দিবেন আর নিশ্চয়ই আল্লহ তায়া’লা অতি ক্ষমাশীল এবং অতি দয়াবান। (সূরা আল ইমরনঃ ৩১)

ফাযায়েলে আমাল (দারুল কিতাব, অক্টোবর ২০০১) পৃষ্ঠা ৮৭০

সাহাবাহ কেরাম রদিয়াল্লহু আ’নহুমদের মুহাব্বাতের বিভিন্ন ঘটনা (৩)

খালেদ রদিয়াল্লহু আ’নহু এর কন্যা আবদা বলেন, আমার পিতা যখনই ঘুমাইবার জন্য শুইতেন ঘুম না আসা পর্যন্ত রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের মুহাব্বাত ও আগ্রহে বিভোর হইয়া থাকিতেন আর মুহাযির ও আনসার সাহাবীদের নাম লইয়া স্মরণ করিতে থাকিতেন, আর বলিতেন যে, ইহারাই আমার মূল ও শাখা।  (অর্থাৎ বড় এবং ছোট)। তাঁহাদের প্রতি আমার মন আকৃষ্ট হইতেছে। হে আল্লহ! আমাকে তাড়াতাড়ি মৃত্যু দিয়া দিন, যাহাতে তাঁহাদের সহিত সাক্ষাত করিতে পারি। এই বলিতে বলিতে ঘুমাইয়া যাইতেন।

একবার আবু বকর সিদ্দিক রদিয়াল্লহু আ’নহু বলিলেন, ইয়া রসুলুল্লহ! আমার নিকট আমার পিতা মুসলমান হওয়ার চেয়ে আপনার চাচা আবু তালেবের মুসলমান হইয়া যাওয়া বেশি কাম্য। কেননা ইহাতে আপনি বেশী খুশি হইবেন। একবার হযরত উ’মার রদিয়াল্লহু আ’নহু রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের চাচা আ’ব্বাস রদিয়াল্লহু আ’নহু কে বলিলেন, আপনার ইসলাম গ্রহণ করা আমার নিকট আমার পিতা মুসলমান হওয়ার চেয়ে অধিক খুশীর বিষয়। কেননা আপনার ইসলাম গ্রহণ রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট অধিক প্রিয়।

হযরত উ’মার রদিয়াল্লহু আ’নহু একবার রাত্রিবেলায় পাহাড়া দিতেছিলেন একটি ঘর হইতে বাতির আলো দেখিতে পাইলেন এবং এক বৃদ্ধার আওয়াজ শুনিতে পাইলেন। সে পশম ধুনিতেছিল আর কবিতা পাঠ করিতেছিল–

মুহা’ম্মাদ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি নেককার লোকদের দুরূদ পৌঁছুক। নিশ্চয়ই ইয়া রসুলুল্লহ! আপনি রাত্রিবেলায় ইবাদাতকারী ছিলেন এবং শেষ রাত্রে ক্রন্দনকারী ছিলেন। হায়! আমি যদি জানিতে পারিতাম যে, আমি ও আমার মাহবুব কখনও একত্রিত হইতে পারিব কিনা। কারণ মৃত্যু বিভিন্ন অবস্থায় আসে। জানিনা আমার মৃত্যু কোন অবস্থায় আসিবে। আর মৃত্যুর পর রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের সহিত সাক্ষাত হইবে কিনা।

হযরত উ’মার রদিয়াল্লহু আ’নহু এই কবিতাগুলি শুনিয়া কাঁদিতে লাগিলেন।

হযরত বিলাল রদিয়াল্লহু আ’নহু এর ঘটনা প্রসিদ্ধ আছে যে, যখন তাঁহার ইন্তেকালের সময় হইল, তখন তাঁহার স্ত্রী বিচ্ছেদের শোকে অস্থির হইয়া বলিতে লাগিলেন, হায় আফসোস! তিনি বলতে লাগিলেন, সুবহানাল্লহ! কতই না আনন্দের বিষয়! কাল মুহা’ম্মাদ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে সাক্ষাত করিব এবং তাঁহার সাহাবাহগণের সহিত মিলিত হইব।

হযরত যায়েদ ইবনে দাছিনা রদিয়াল্লহু আ’নহু এর ঘটনা–(যাহা পঞ্চম অধ্যায়ে ৯নং ঘটনায় বর্ণিত হইয়াছে) যখন তাঁহাকে শুলিতে চড়ানো হইয়াছিল তখন আবু সুফিয়ান (তখনও সাহাবী হন নাই) জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, তুমি কি ইহা পছন্দ কর যে, আমরা তোমাকে মুক্ত করিয়া দিই আর (আল্লহ না করুন) তোমার পরিবর্তে মুহা’ম্মাদ (সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সহিত এই ব্যবহার করি?  তখন যায়েদ রদিয়াল্লহু আ’নহু উত্তরে বলিলেন, আল্লহর কসম, আমি ইহাও পছন্দ করি না যে, রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম নিজ ঘরে থাকা অবস্থায় কাঁটাবিদ্ধ হইবেন আর উহার পরিবর্তে আমি আমার ঘরে আরামে থাকিতে পারিব। আবু সুফিয়ান বলিতে লাগিল, আমি কখনও কোন ব্যক্তির সহিত কাহাকেও এই পরিমাণ মুহাব্বাত করিতে দেখি নাই, যে পরিমাণ মুহা’ম্মাদ (সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সহিত তাঁহার সঙ্গীদের মুহাব্বাত রহিয়াছে।

ফাযায়েলে আমাল (দারুল কিতাব, অক্টোবর ২০০১) পৃষ্ঠা ৮৬৯-৮৭০

সাহাবাহ কেরাম রদিয়াল্লহু আ’নহুমদের মুহাব্বাতের বিভিন্ন ঘটনা (২)

এক সাহাবী রদিয়াল্লহু আ’নহু রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমতে হাজির হইলেন এবং আরজ করিলেন, আপনার মুহাব্বাত আমার নিকট আমার জান-মাল এবং আমার পরিবার-পরিজনের চাইতেও বেশী। আমি আমার ঘরে থাকা অবস্থায় যখনই আপনার কথা মনে পড়ে সহ্য করতে পারি না যেই পর্যন্ত আপনার খেদমতে হাজির হইয়া আপনার যিয়ারত না করিব। আমার চিন্তা হয় যে, মৃত্যু তো আপনারও আসিবে, আমারও অবশ্যই আসিবে। ইহার পর আপনি নবীদের মর্তবায় চলিয়া যাইবেন। আমার ভয় হয় আর আপনাকে দেখিতে পাইব না। রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম এই কথার উত্তরে চুপ থাকিলেন। এমন সময় হযরত জিবরাঈল আ’লাইহিস সালাম তশরীফ আনিলেন এবং এই আয়াত শুনাইলেন–

وَمَن يُطِعِ اللَّـهَ وَالرَّسُولَ فَأُولَـٰئِكَ مَعَ الَّذِينَ أَنْعَمَ اللَّـهُ عَلَيْهِم مِّنَ النَّبِيِّينَ وَالصِّدِّيقِينَ وَالشُّهَدَاءِ وَالصَّالِحِينَ ۚ وَحَسُنَ أُولَـٰئِكَ رَفِيقًا ﴿٦٩﴾ ذَٰلِكَ الْفَضْلُ مِنَ اللَّـهِ ۚ وَكَفَىٰ بِاللَّـهِ عَلِيمًا ﴿﴾٧٠

অর্থঃ যাহারা আল্লহ তায়া’লা ও রসূলের আনুগত্য করিবে তাহারাও জান্নাতে ঐ সমস্ত লোকদের সহিত থাকিবে যাহাদের প্রতি আল্লহ তায়া’লা নিয়ামাত দান করিয়াছেন অর্থাৎ নবীগণ, সিদ্দিকগণ, শহীদগণ, নেককারগণ। আর ইহারা অতি উত্তম সঙ্গী এবং তাহাদের সঙ্গলাভ একমাত্র আল্লহ তায়া’লার অনুগ্রহ। আর আল্লহ তায়া’লা প্রত্যেকের আমাল সম্পর্কে খুব ভালরূপে অবগত আছেন। (সূরা নিসাঃ ৬৯-৭০)

এই ধরনের ঘটনা বহু সাহাবীর জীবনে ঘটিয়াছে। আর এইরূপ হওয়াই জরুরী ছিল। কেননা যেখানে মুহাব্বাত, সেখানে হাজারো সন্দেহ। রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম ঐ সাহাবীর উত্তরে এই আয়াতই শুনাইয়াছিলেন।

এক সাহাবী রদিয়াল্লহু আ’নহু রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমতে হাজির হইয়া আরজ করিলেন, ইয়া রসুলুল্লহ! আমার আপনার সহিত এইরূপ মুহাব্বাত যে, যখন আপনার কথা মনে পড়ে, যদি ঐ সময়ে যিয়ারত না করিয়া লই তবে ইহা নিশ্চিত যে, আমার প্রাণ বাহির হইয়া যাইবে কিন্তু আমার চিন্তা হইল যে, আমি যদি জান্নাতে দাখিলও হই তবুও আপনার নিচের দরজায় থাকিব। আপনার দিদার ব্যতীত জান্নাতও বড় কষ্ট হইবে। তখন তিনি উক্ত আয়াতই শুনাইলেন।

অপর এক হাদীসে বর্ণিত আছে, এক আনসারী সাহাবী রদিয়াল্লহু আ’নহু রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমতে অত্যন্ত চিন্তিত অবস্থায় হাজির হইলেন। রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞাসা করিলেন তুমি, চিন্তাযুক্ত কেন? তিনি উত্তরে বলিলেন, ইয়া রসুলুল্লহ! আমি একটি চিন্তায় আছি। রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞাসা করিলেন, কি চিন্তা? তিনি আরজ করিলেন, ইয়া রসুলুল্লহ! আমরা সকাল-বিকাল আপনার খেতমতে হাজির হই, আপনার যিয়ারত করিয়া আনন্দ লাভ করি, আপনার খেদমতে বসি। কাল কিয়ামাতে তো আপনি নবীদের মর্তবায় পৌঁছিয়া যাইবেন, আমরা তো ঐ পর্যন্ত পৌঁছিতে পারিব না। রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম চুপ থাকিলেন। যখন উপরোক্ত আয়াত নাযিল হইল তখন রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম ঐ আনসারীকেও ডাকিলেন এবং ইহার সুসংবাদ দিলেন।

এক হাদীসে আছে, বহু সাহাবী এই প্রশ্ন করিয়াছেন এবং রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম তাহাদিগকে এই আয়াত শুনাইয়াছেন।

এক হাদীসে আছে, সাহাবাহ কেরাম রদিয়াল্লহু আ’নহুম আরজ করিলেন, ইয়া রসুলুল্লহ! ইহা তো সুস্পষ্ট বিষয় যে, নবীর মর্যাদা উম্মতের উপরে রহিয়াছে। জান্নাতে তাঁহারা উপরের দরজায় থাকিবেন। তাহা হইলে একত্র হওয়ার ব্যবস্থা কি হইবে? রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলিলেন, উপরের স্তরের লোকেরা নিচের স্তরে আসিবে, তাহাদের নিকট বসিবে কথাবার্তা বলিবে। (দুররে মানসুর)

রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন, আমার সহিত অধিক মুহাব্বাতকারী কিছু লোক এমন হইবে যাহারা আমার পরে জন্মগ্রহণ করিবে এবং তাহাদের এই আকাঙ্ক্ষা হইবে যে, যদি সমস্ত ধন-সম্পদ, পরিবার-পরিজনের বিনিময়েও আমাকে দেখিতে পাইত।

ফাযায়েলে আমাল (দারুল কিতাব, অক্টোবর ২০০১) পৃষ্ঠা ৮৬৭-৮৬৯

সাহাবাহ কেরাম রদিয়াল্লহু আ’নহুমদের মুহাব্বাতের বিভিন্ন ঘটনা

হযরত আ’লী রদিয়াল্লহু আ’নহু এর নিকট কেহ জিজ্ঞাসা করিল, রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের সহিত আপনার মুহাব্বাত কি পরিমাণ ছিল? হযরত আ’লী রদিয়াল্লহু আ’নহু বলিলেন, আল্লহর কসম, রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের নিকট আমাদের ধন-সম্পদ হইতে, আমাদের সন্তান-সন্ততি হইতে, আমাদের মাতাগণ হইতে এবং কঠিন পিপাসা অবস্থায় ঠান্ডা পানি হইতেও অধিক প্রিয় ছিলেন।

ফায়দাঃ সত্য বলিয়াছেন। বাস্তবে সাহাবাহ কেরাম রদিয়াল্লহু আ’নহুমদের  এই অবস্থাই ছিল। আর হইবেই না কেন? তাঁহারা পরিপূর্ণ ঈমানের অধিকারী ছিলেন, আল্লহ তায়া’লা এরশাদ করিয়াছেন–

قُلْ إِن كَانَ آبَاؤُكُمْ وَأَبْنَاؤُكُمْ وَإِخْوَانُكُمْ وَأَزْوَاجُكُمْ وَعَشِيرَتُكُمْ وَأَمْوَالٌ اقْتَرَفْتُمُوهَا وَتِجَارَةٌ تَخْشَوْنَ كَسَادَهَا وَمَسَاكِنُ تَرْضَوْنَهَا أَحَبَّ إِلَيْكُم مِّنَ اللَّـهِ وَرَسُولِهِ وَجِهَادٍ فِي سَبِيلِهِ فَتَرَبَّصُوا حَتَّىٰ يَأْتِيَ اللَّـهُ بِأَمْرِهِ ۗ وَاللَّـهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِينَ

অর্থঃ আপনি তাহাদিগকে বলিয়া দিন যদি তোমাদের পিতা, তোমাদের পুত্র, তোমাদের ভাই, তোমাদের স্ত্রীগণ, তোমাদের আত্মীয়-স্বজন আর ঐ ধন-সম্পদ যাহা তোমরা উপার্জন করিয়াছ, আর ঐ ব্যবসা যাহার মধ্যে তোমরা লোকসানের আশংকা কর আর ঐ ঘরবাড়ী যাহা তোমরা ভালবাস যদি (এইসব কিছু) তোমাদের কাছে আল্লহ তায়া’লা এবং তাঁহার রসূল ও তাঁহার পথে জিহাদ করার চাইতে অধিক প্রিয় হয়, তবে তোমরা আল্লহ তায়া’লার নির্দেশের অপেক্ষা কর। আর আল্লহ তায়া’লা অবাধ্য লোকদিগকে তাহাদের মকসুদ পর্যন্ত পৌঁছান না। (সুরা তওবাহঃ ২৪ – বয়ানুল কুরআন)

উক্ত আয়াতে আল্লহ তায়া’লা ও তাঁহার রসূলের মুহাব্বাত এই সমস্ত জিনিস হইতে কম হওয়ার ব্যাপারে ভয় দেখানো হইয়াছে।

হযরত আনাস রদিয়াল্লহু আ’নহু বলেন, রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম ফরমাইয়াছেন,  তোমাদের মধ্যে কেহ ঐ পর্যন্ত মুমিন হইতে পারিবে না যতক্ষন পর্যন্ত তাহার নিকট আমার মুহাব্বাত ও ভালবাসা তাহার পিতা, সন্তান-সন্ততি এবং সমস্ত মানুষ হইতে বেশি না হইবে।

হযরত আবু হুরইরহ রদিয়াল্লহু আ’নহু হইতেও অনুরূপ বিষয় বর্ণিত হইয়াছে।

উলামা কেরাম বলেন, উপরোক্ত হাদীসে মুহাব্বাত দ্বারা এখতিয়ারী মুহাব্বাত অর্থাৎ ইচ্ছাকৃত মুহাব্বাত বুঝানো হইয়াছে। গায়ের এখতিয়ারী মুহাব্বাত অর্থাৎ স্বভাবসুলভ বা অনিচ্ছাকৃত মুহাব্বাত এখানে উদ্দেশ্য নহে। ইহাও হইতে পারে যে,  যদি স্বভাবসুলভ মুহাব্বাত উদ্দেশ্য হয় তবে ঈমান দ্বারা পরিপূর্ণ দরজার ঈমান উদ্দেশ্য হইবে–যেমন সাহাবাহ কেরামদের মধ্যে ছিল।

হযরত আনাস রদিয়াল্লহু আ’নহু বর্ণনা করেন, রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম ফরমাইয়াছেন, তিনিটি বস্তু এমন যে ব্যক্তির মধ্যে উহা পাওয়া যাইবে ঈমানের স্বাদ ও ঈমানের মজা তাহার নসীব হইয়া যাইবে। এক) আল্লহ তায়া’লা ও তাঁহার রসূলের মুহাব্বাত সমস্ত জিনিস হইতে বেশি হইবে। দুই) কাহাকেও ভালবাসিলে আল্লহ তায়া’লার উদ্দেশ্যেই ভালবাসিবে। তিন) কুফরের দিকে ফিরিয়া যাওয়া তাহার কাছে এমন কষ্টকর ও মুশকিল মনে হয় যেমন আগুনে পতিত হওয়া।

হযরত উ’মার রদিয়াল্লহু আ’নহু একবার আরজ করিলেন, ইয়া রসুলুল্লহ! আপনি আমার নিকট আমার জান ব্যতীত অন্য সমস্ত বস্তু হইতে বেশি প্রিয়। রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলিলেন, কোন ব্যক্তি ঐ পর্যন্ত মুমিন হইতে পারিবে না যতক্ষন আমার মুহাব্বাত তাহার নিকট তাহার জানের চাইতেও বেশি না হইবে। হযরত উ’মার রদিয়াল্লহু আ’নহু বলিলেন, ইয়া রসুলুল্লহ! আপনি আমার নিকট আমার জানের চাইতেও বেশি প্রিয়। তখন রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলিলেন, এখন হে উ’মার

আলেমগণ এই কথার দুইটি অর্থ বলিয়াছেন। একটি হইল এখন তোমার ঈমান পরিপূর্ণ হইয়াছে। অপরটি হইল সতর্ক করা হইয়াছে অর্থাৎ এতক্ষনে তোমার মধ্যে এই জিনিস পয়দা হইয়াছে যে, আমি তোমার নিকট তোমার প্রাণের চেয়েও বেশী প্রিয়, তথচ ইহা তো প্রথম হইতেই হওয়া উচিত ছিল।

সুহাইল তুস্তারী রহমাতুল্লহ আ’লাইহি বলেন, যে ব্যক্তি সর্বস্থায় রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামকে নিজের অভিভাবক মনে না করে এবং নিজের নফসকে নিজের মালিকানায় মনে করে যে সুন্নতের স্বাদ পাইতে পারে না।

এক সাহাবী রদিয়াল্লহু আ’নহু রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট আসিয়া আরজ করিলেন, ইয়া রসুলুল্লহ! কিয়ামাত কখন আসিবে? রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলিলেন, কিয়ামাতের জন্য কি প্রস্তুতি গ্রহণ করিয়াছ, যে উহার জন্য অপেক্ষা করিতেছ? তিনি আরজ করিলেন, ইয়া রসুলুল্লহ! আমি অধিক পরিমাণ নামায, রোযা ও সদকা তো তৈয়ার করিয়া রাখি নাই, তবে আল্লহ তায়া’লা ও তাঁহার রসূলের মুহাব্বাত আমার অন্তরে রহিয়াছে। রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলিলেন, কিয়ামাতের দিন তুমি তাহারই সহিত থাকিবে যাহার সহিত মুহাব্বাত রাখিয়াছ।

রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের এরশাদ, মানুষের হাশর তাহারই সহিত হইবে যাহার সহিত তাহার মুহাব্বাত রহিয়াছে। এই হাদীস কয়েক জন সাহাবী বর্ণনা করিয়াছেন তন্মধ্যে আ’ব্দুল্লহ ইবনে মাসউদ, আবু মূসা আশআরী, সাফওয়ান, আবুযার রদিয়াল্লহু আ’নহুম প্রমুখ রহিয়াছেন।

হযরত আনাস রদিয়াল্লহু আ’নহু বলেন, সাহাবাহ কেরাম রদিয়াল্লহু আ’নহুম এর এরশাদ শুনিয়া যত খুশি হইয়াছিলেন আর কোন কিছুতেই এত খুশি হন নাই। আর ইহা স্পষ্ট বিষয় যে, এরূপ হওয়াটাই সাভাবিক ছিল। কেননা রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের মুহাব্বাত তো তাহাদের শিরা-উপশিরায় গাঁথা ছিল। সুতরাং তাঁহারা কেন খুশি হইবেন না।

হযরত ফাতিমা রদিয়াল্লহু আ’নহা এর ঘর প্রথমে রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট হইতে এ্কটু দূরে ছিল। একবার রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলিলেন, আমার মনে চাহিতেছিল যে, তোমার ঘর যদি একেবারে নিকটে হইত। হযরত ফাতিমা রদিয়াল্লহু আ’নহা আরজ করিলেন, হারেছা রদিয়াল্লহু আ’নহু এর ঘর আপনার নিকটে। তাঁহাকে বলিয়া দিন, তিনি যেন আমার ঘরের সহিত বিনিময় করিয়া লন। রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলিলেন, তাহার সহিত আগেও বিনিময় হইয়াছে এখন তো লজ্জা হইতেছে। হারেছা রদিয়াল্লহু আ’নহু এই সংবাদ পাইয়া তৎক্ষনাৎ উপস্থিত হইয়া আরজ করিলেন, ইয়া রসুলুল্লহ! আমি জানিতে পারিয়াছি আপনি ফাতিমা রদিয়াল্লহু আ’নহা এর ঘর আপনার নিকটে হওয়া চাহিতেছেন। এইগুলি আমার ঘর এইগুলি হইতে নিকটবর্তী আর কোন ঘর নাই। যেই ঘরটি পছন্দ হয় বিনিময় করিয়া নিন। ইয়া রসুলুল্লহ! আমি এবং আমার মাল তো আল্লহ তায়া’লা ও তাঁহার রসূলের জন্যই। ইয়া রসুলুল্লহ! আল্লহর কসম, আপনি যে মাল নিয়া নিবেন উহা আমার নিকট বেশি পছন্দনীয় ঐ মাল হইতে যাহা আমার নিকট থাকিয়া যাইবে। রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলিলেন, তুমি সত্য বলিয়াছ। অতঃপর তাঁহার জন্য বরকতের দুআ করিলেন এবং ঘর বিনিময় করিয়া লইলেন। (তাবাকাত)

ফাযায়েলে আমাল (দারুল কিতাব, অক্টোবর ২০০১) পৃষ্ঠা ৮৬৪-৮৬৭