হযরত আ’লী রদিয়াল্লহু আ’নহু এর নিকট কেহ জিজ্ঞাসা করিল, রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের সহিত আপনার মুহাব্বাত কি পরিমাণ ছিল? হযরত আ’লী রদিয়াল্লহু আ’নহু বলিলেন, আল্লহর কসম, রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের নিকট আমাদের ধন-সম্পদ হইতে, আমাদের সন্তান-সন্ততি হইতে, আমাদের মাতাগণ হইতে এবং কঠিন পিপাসা অবস্থায় ঠান্ডা পানি হইতেও অধিক প্রিয় ছিলেন।
ফায়দাঃ সত্য বলিয়াছেন। বাস্তবে সাহাবাহ কেরাম রদিয়াল্লহু আ’নহুমদের এই অবস্থাই ছিল। আর হইবেই না কেন? তাঁহারা পরিপূর্ণ ঈমানের অধিকারী ছিলেন, আল্লহ তায়া’লা এরশাদ করিয়াছেন–
قُلْ إِن كَانَ آبَاؤُكُمْ وَأَبْنَاؤُكُمْ وَإِخْوَانُكُمْ وَأَزْوَاجُكُمْ وَعَشِيرَتُكُمْ وَأَمْوَالٌ اقْتَرَفْتُمُوهَا وَتِجَارَةٌ تَخْشَوْنَ كَسَادَهَا وَمَسَاكِنُ تَرْضَوْنَهَا أَحَبَّ إِلَيْكُم مِّنَ اللَّـهِ وَرَسُولِهِ وَجِهَادٍ فِي سَبِيلِهِ فَتَرَبَّصُوا حَتَّىٰ يَأْتِيَ اللَّـهُ بِأَمْرِهِ ۗ وَاللَّـهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِينَ
অর্থঃ আপনি তাহাদিগকে বলিয়া দিন যদি তোমাদের পিতা, তোমাদের পুত্র, তোমাদের ভাই, তোমাদের স্ত্রীগণ, তোমাদের আত্মীয়-স্বজন আর ঐ ধন-সম্পদ যাহা তোমরা উপার্জন করিয়াছ, আর ঐ ব্যবসা যাহার মধ্যে তোমরা লোকসানের আশংকা কর আর ঐ ঘরবাড়ী যাহা তোমরা ভালবাস যদি (এইসব কিছু) তোমাদের কাছে আল্লহ তায়া’লা এবং তাঁহার রসূল ও তাঁহার পথে জিহাদ করার চাইতে অধিক প্রিয় হয়, তবে তোমরা আল্লহ তায়া’লার নির্দেশের অপেক্ষা কর। আর আল্লহ তায়া’লা অবাধ্য লোকদিগকে তাহাদের মকসুদ পর্যন্ত পৌঁছান না। (সুরা তওবাহঃ ২৪ – বয়ানুল কুরআন)
উক্ত আয়াতে আল্লহ তায়া’লা ও তাঁহার রসূলের মুহাব্বাত এই সমস্ত জিনিস হইতে কম হওয়ার ব্যাপারে ভয় দেখানো হইয়াছে।
হযরত আনাস রদিয়াল্লহু আ’নহু বলেন, রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম ফরমাইয়াছেন, তোমাদের মধ্যে কেহ ঐ পর্যন্ত মুমিন হইতে পারিবে না যতক্ষন পর্যন্ত তাহার নিকট আমার মুহাব্বাত ও ভালবাসা তাহার পিতা, সন্তান-সন্ততি এবং সমস্ত মানুষ হইতে বেশি না হইবে।
হযরত আবু হুরইরহ রদিয়াল্লহু আ’নহু হইতেও অনুরূপ বিষয় বর্ণিত হইয়াছে।
উলামা কেরাম বলেন, উপরোক্ত হাদীসে মুহাব্বাত দ্বারা এখতিয়ারী মুহাব্বাত অর্থাৎ ইচ্ছাকৃত মুহাব্বাত বুঝানো হইয়াছে। গায়ের এখতিয়ারী মুহাব্বাত অর্থাৎ স্বভাবসুলভ বা অনিচ্ছাকৃত মুহাব্বাত এখানে উদ্দেশ্য নহে। ইহাও হইতে পারে যে, যদি স্বভাবসুলভ মুহাব্বাত উদ্দেশ্য হয় তবে ঈমান দ্বারা পরিপূর্ণ দরজার ঈমান উদ্দেশ্য হইবে–যেমন সাহাবাহ কেরামদের মধ্যে ছিল।
হযরত আনাস রদিয়াল্লহু আ’নহু বর্ণনা করেন, রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম ফরমাইয়াছেন, তিনিটি বস্তু এমন যে ব্যক্তির মধ্যে উহা পাওয়া যাইবে ঈমানের স্বাদ ও ঈমানের মজা তাহার নসীব হইয়া যাইবে। এক) আল্লহ তায়া’লা ও তাঁহার রসূলের মুহাব্বাত সমস্ত জিনিস হইতে বেশি হইবে। দুই) কাহাকেও ভালবাসিলে আল্লহ তায়া’লার উদ্দেশ্যেই ভালবাসিবে। তিন) কুফরের দিকে ফিরিয়া যাওয়া তাহার কাছে এমন কষ্টকর ও মুশকিল মনে হয় যেমন আগুনে পতিত হওয়া।
হযরত উ’মার রদিয়াল্লহু আ’নহু একবার আরজ করিলেন, ইয়া রসুলুল্লহ! আপনি আমার নিকট আমার জান ব্যতীত অন্য সমস্ত বস্তু হইতে বেশি প্রিয়। রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলিলেন, কোন ব্যক্তি ঐ পর্যন্ত মুমিন হইতে পারিবে না যতক্ষন আমার মুহাব্বাত তাহার নিকট তাহার জানের চাইতেও বেশি না হইবে। হযরত উ’মার রদিয়াল্লহু আ’নহু বলিলেন, ইয়া রসুলুল্লহ! আপনি আমার নিকট আমার জানের চাইতেও বেশি প্রিয়। তখন রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলিলেন, এখন হে উ’মার।
আলেমগণ এই কথার দুইটি অর্থ বলিয়াছেন। একটি হইল এখন তোমার ঈমান পরিপূর্ণ হইয়াছে। অপরটি হইল সতর্ক করা হইয়াছে অর্থাৎ এতক্ষনে তোমার মধ্যে এই জিনিস পয়দা হইয়াছে যে, আমি তোমার নিকট তোমার প্রাণের চেয়েও বেশী প্রিয়, তথচ ইহা তো প্রথম হইতেই হওয়া উচিত ছিল।
সুহাইল তুস্তারী রহমাতুল্লহ আ’লাইহি বলেন, যে ব্যক্তি সর্বস্থায় রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামকে নিজের অভিভাবক মনে না করে এবং নিজের নফসকে নিজের মালিকানায় মনে করে যে সুন্নতের স্বাদ পাইতে পারে না।
এক সাহাবী রদিয়াল্লহু আ’নহু রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট আসিয়া আরজ করিলেন, ইয়া রসুলুল্লহ! কিয়ামাত কখন আসিবে? রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলিলেন, কিয়ামাতের জন্য কি প্রস্তুতি গ্রহণ করিয়াছ, যে উহার জন্য অপেক্ষা করিতেছ? তিনি আরজ করিলেন, ইয়া রসুলুল্লহ! আমি অধিক পরিমাণ নামায, রোযা ও সদকা তো তৈয়ার করিয়া রাখি নাই, তবে আল্লহ তায়া’লা ও তাঁহার রসূলের মুহাব্বাত আমার অন্তরে রহিয়াছে। রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলিলেন, কিয়ামাতের দিন তুমি তাহারই সহিত থাকিবে যাহার সহিত মুহাব্বাত রাখিয়াছ।
রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের এরশাদ, মানুষের হাশর তাহারই সহিত হইবে যাহার সহিত তাহার মুহাব্বাত রহিয়াছে। এই হাদীস কয়েক জন সাহাবী বর্ণনা করিয়াছেন তন্মধ্যে আ’ব্দুল্লহ ইবনে মাসউদ, আবু মূসা আশআরী, সাফওয়ান, আবুযার রদিয়াল্লহু আ’নহুম প্রমুখ রহিয়াছেন।
হযরত আনাস রদিয়াল্লহু আ’নহু বলেন, সাহাবাহ কেরাম রদিয়াল্লহু আ’নহুম এর এরশাদ শুনিয়া যত খুশি হইয়াছিলেন আর কোন কিছুতেই এত খুশি হন নাই। আর ইহা স্পষ্ট বিষয় যে, এরূপ হওয়াটাই সাভাবিক ছিল। কেননা রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের মুহাব্বাত তো তাহাদের শিরা-উপশিরায় গাঁথা ছিল। সুতরাং তাঁহারা কেন খুশি হইবেন না।
হযরত ফাতিমা রদিয়াল্লহু আ’নহা এর ঘর প্রথমে রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট হইতে এ্কটু দূরে ছিল। একবার রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলিলেন, আমার মনে চাহিতেছিল যে, তোমার ঘর যদি একেবারে নিকটে হইত। হযরত ফাতিমা রদিয়াল্লহু আ’নহা আরজ করিলেন, হারেছা রদিয়াল্লহু আ’নহু এর ঘর আপনার নিকটে। তাঁহাকে বলিয়া দিন, তিনি যেন আমার ঘরের সহিত বিনিময় করিয়া লন। রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলিলেন, তাহার সহিত আগেও বিনিময় হইয়াছে এখন তো লজ্জা হইতেছে। হারেছা রদিয়াল্লহু আ’নহু এই সংবাদ পাইয়া তৎক্ষনাৎ উপস্থিত হইয়া আরজ করিলেন, ইয়া রসুলুল্লহ! আমি জানিতে পারিয়াছি আপনি ফাতিমা রদিয়াল্লহু আ’নহা এর ঘর আপনার নিকটে হওয়া চাহিতেছেন। এইগুলি আমার ঘর এইগুলি হইতে নিকটবর্তী আর কোন ঘর নাই। যেই ঘরটি পছন্দ হয় বিনিময় করিয়া নিন। ইয়া রসুলুল্লহ! আমি এবং আমার মাল তো আল্লহ তায়া’লা ও তাঁহার রসূলের জন্যই। ইয়া রসুলুল্লহ! আল্লহর কসম, আপনি যে মাল নিয়া নিবেন উহা আমার নিকট বেশি পছন্দনীয় ঐ মাল হইতে যাহা আমার নিকট থাকিয়া যাইবে। রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলিলেন, তুমি সত্য বলিয়াছ। অতঃপর তাঁহার জন্য বরকতের দুআ করিলেন এবং ঘর বিনিময় করিয়া লইলেন। (তাবাকাত)
ফাযায়েলে আমাল (দারুল কিতাব, অক্টোবর ২০০১) পৃষ্ঠা ৮৬৪-৮৬৭