Archive for the ‘রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি ভালবাসার নমুনা’ Category

রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি ভালবাসার নমুনা

যদিও এই পর্যন্ত যত ঘটনা বর্ণনা করা হইয়াছে সবগুলিই মুহাব্বাতের আশ্চর্য দৃষ্টান্ত ছিল। মুহাব্বাতই তাঁহাদের আবেগপূর্ণ জীবনের উৎস ছিল যাহার দরুন না জানের পরওয়া ছিল, না  জীবনের আকাঙ্ক্ষা, না মালের খেয়াল, না দুঃখ কষ্টের চিন্তা, না মৃত্যুর ভয়। ইহা ছাড়া মুহাব্বাত ও ভালবাসা বর্ণনা করিবার বিষয় নহে। উহা এমন একটি অবস্থা যাহা ভাষা ও বর্ণনার বহু উর্ধে। মুহাব্বাতই এমন এক জিনিস যাহা অন্তরে বদ্ধমুল হইয়া যাওয়ার পর মাহবুব অর্থাৎ প্রেমাস্পদকে সবকিছুর উর্ধে তুলিয়া দেয়। উহার মুকাবেলায় লজ্জা শরম, মান-মর্যাদা কোন কিছুরই অস্তিত্ব থাকে না। আল্লহ তায়া’লা যদি স্বীয় অনুগ্রহে এবং আপন মাহবুবের উসিলায় তাঁহার ও তাঁহার পাক রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের কিছু মুহাব্বাত ও ভালবাসা দান করেন, তবে প্রত্যেক ইবাদাতে স্বাদ পাওয়া যাইবে এবং দ্বীনের জন্য সকল কষ্টই আরাম মনে হইবে।

ফাযায়েলে আমাল (দারুল কিতাব, অক্টোবর ২০০১) পৃষ্ঠা ৮৪৮-৮৪৯

হযরত আবু বকর রদিয়াল্লহু আ’নহু এর ইসলামের ঘোষণা ও নির্যাতন

ইসলামের প্রথম যুগে যাঁহারা মুসলমান হইতেন তাঁহার নিজেদের ইসলাম গ্রহণকে যথাসাধ্য গোপন রাখিতেন। রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের পক্ষ হইতেও কাফেরদের নির্যাতনের কারণে গোপন রাখার নির্দেশ দেওয়া হইত। মুসলমানদের সংখ্যা যখন উনচল্লিশে পৌঁছিয়া যায় তখন হযরত আবু বকর সিদ্দীক রদিয়াল্লহু আ’নহু প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচারের আবেদন জানাইলেন। রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম প্রথমে অস্বীকার করিলেন। হযরত আবু বকর রদিয়াল্লহু আ’নহু এর বারবার অনুরোধের কারণে অবশেষে অনুমতি দিলেন এবং মুসলমানদের লইয়া কা’বাঘরে তশরীফ লইয়া গেলেন। হযরত আবু বকর রদিয়াল্লহু আ’নহু তাবলীগি খুতবা পাঠ করিলেন। ইহাই ছিল ইসলামের সর্বপ্রথম খুতবা। ঐ দিনই রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের চাচা ‘সাইয়্যেদুশ শুহাদা’ (শহীদগণের সর্দার) হযরত হামযা রদিয়াল্লহু আ’নহু ইসলাম গ্রহণ করেন। ইহার তিনদিন পর হযরত উ’মার রদিয়াল্লহু আ’নহু ইসলাম গ্রহণ করেন। খুতবা শুরু হইতেই কাফের-মুশরিকরা চতুর্দিক হইতে আসিয়া মুসলমানদের উপর ঝাঁপাইয়া পড়িল। হযরত আবু বকর রদিয়াল্লহু আ’নহু যাঁর সম্মান ও মর্যাদা মক্কার সকলের নিকট স্বীকৃত ছিল। ইহা সত্ত্বেও তাঁহাকে এত প্রহার করিল যে, তাঁহার সম্পূর্ণ চেহারা মুবারক রক্তাক্ত হইয়া গেল। নাক কান রক্তে রঞ্চিত হইয়া গেল। তাঁহাকে চেনা যাইতেছিল না। জুতা ও লাথি দ্বারা আঘাত করিল, পদদলন করিল। যাহা করা উচিত ছিল না সবই করিল। হযরত আবু বকর সিদ্দীক রদিয়াল্লহু আ’নহু বেহুঁশ হইয়া গেলেন। তাঁহার গোত্র বনি তামীমের লোকেরা সংবাদ পাইয়া তুলিয়া লইয়া আসিল। কাহারো সন্দেহ ছিল না যে, হযরত আবু বকর রদিয়াল্লহু আ’নহু এই পাশবিক অত্যাচার হইতে জীবনে বাঁচিয়া উঠিতে পারিবেন না। বনু তামীম মাসজিদে আসিল এবং ঘোষণা করিল যে, হযরত আবু বকর রদিয়াল্লহু আ’নহু যদি এই দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন তবে আমরা তাঁহার বদলায় উতবা ইবনে রবীয়াকে হত্যা করিব। উতবা হযরত আবু বকর রদিয়াল্লহু আ’নহু এর অত্যাচারের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি বর্বরতা প্রদর্শন করিয়াছিল। সন্ধ্যা পর্যন্ত আবু বকর রদিয়াল্লহু আ’নহু বেহুঁশ অবস্থায় ছিলেন। ডাকাডাকি সত্ত্বেও সাড়া দিতে বা কথা বলিতে পারিতেছিলেন না। সন্ধ্যায় অনেক ডাকাডাকির পর তিনি কথা বলিলেন। তবে সর্বপ্রথম কথা এইছিল যে, রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম কেমন আছেন। লোকেরা এই ব্যাপারে তাঁহাকে বহু তিরষ্কার করিল যে, তাহার সহিত চলার কারণেই তো তোমার উপর এই বিপদ আসিয়াছে। এবং সারাদিন মৃত্যুমুখে থাকিবার পর কথা বলিলে তো তাহাও রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামেরই জযবা এবং তাঁহারই আকাঙ্ক্ষা! অতঃপর লোকজন তাঁহার নিকট হইতে চলিয়া গেল। কেননা বিরক্তিও ছিল আবার ইহাও ছিল যে, শেষ পর্যন্ত বাঁচিয়া আছেন যেহেতু কথা বলিতে পারিয়াছেন। তাহারা আবু বকর রদিয়াল্লহু আ’নহু এর মাতা উম্মে খাইরকে (রদিয়াল্লহু আ’নহা) বলিয়া গেল যে, তাহার জন্য কিছু খানা পিনার ব্যবস্থা করুন। তিনি কিছু তৈরী করিয়া আনিলেন এবং খাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করিলেন। কিন্তু হযরত আবু বকর রদিয়াল্লহু আ’নহু এর সেই একই কথা ছিল যে, রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম কেমন আছেন, তাঁহার কি অবস্থা? তাঁহার মাতা বলিলেন, তিনি কেমন আছেন আমি জানি না। হযরত আবু বকর রদিয়াল্লহু আ’নহু বলিলেন, উম্মে জামীল (রদিয়াল্লহু আ’নহা) (হযরত উ’মার রদিয়াল্লহু আ’নহু এর বোন)এর কাছে গিয়া জিজ্ঞাসা করিয়া দেখুন তাঁহার কি অবস্থা। সে বেচারী তাঁহার পুত্রের নির্যাতিত অবস্থায় ব্যাকুল মনের আবেদন পুরা করিবার জন্য উম্মে জামীলের (রদিয়াল্লহু আ’নহা) নিকট গিয়া মুহা’ম্মাদ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম এর অবস্থা জিজ্ঞাসা করিলেন। তিনিও সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী নিজের ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারটি গোপন রাখিয়া ছিলেন। তিনি বলিলেন, আমি কি জানি কে মুহা’ম্মাদ (সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) আর কে আবু বকর (রদিয়াল্লহু আ’নহু)? তবে তোমার ছেলের কথা শুনিয়া দুঃখ হইতেছে। যদি তুমি বল তবে আমি যাইয়া তাহার অবস্থা দেখিতে পারি। উম্মে খাইর (রদিয়াল্লহু আ’নহু) ইহাতে সম্মত হইলেন। তিনি তাঁহার সহিত গেলেন এবং হযরত আবু বকর রদিয়াল্লহু আ’নহু অবস্থা দেখিয়া সহ্য করিতে পারিলেন না। বেদমভাবে কাঁদিতে শুরু করিলেন যে, পাপিষ্ঠরা কি অবস্থা করিয়াছে, আল্লহ তায়া’লা তাহাদিগকে তাহাদের কৃতকর্মের শাস্তি দান করুন। হযরত আবু বকর রদিয়াল্লহু আ’নহু আবারও জিজ্ঞাসা করিলেন, মুহা’ম্মাদ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম কেমন আছেন? উম্মে জামীল রদিয়াল্লহু আ’নহা হযরত আবু বকর রদিয়াল্লহু আ’নহু এর মাতা দিকে ইশারা করিয়া বলিলেন, তিনি শুনিতেছেন। আবু বকর রদিয়াল্লহু আ’নহু বলিলেন তাঁহার ব্যাপারে ভয় করিও না। তখন উম্মে জামীল রদিয়াল্লহু আ’নহা ভাল খবর শুনাইলেন। হযরত আবু বকর রদিয়াল্লহু আ’নহু জিজ্ঞাসা করিলেন, তিনি এখন কোথায় আছেন? উম্মে জামীল রদিয়াল্লহু আ’নহা বলিলেন, আরকাম রদিয়াল্লহু আ’নহু এর ঘরে আছেন। হযরত আবু বকর রদিয়াল্লহু আ’নহু বলিলেন, আমার জন্য আল্লহর কসম, ততক্ষন পর্যন্ত না কোন জিনিস খাইব, না পান করিব যতক্ষন পর্যন্ত রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাক্ষাত লাভ না করিব। তাঁহার মায়ের অস্থিরতা ছিল যে, সে কিছু আহার করুক আর তিনি কসম খাইলেন যে, যতক্ষন পর্যন্ত সাক্ষাত না করিব কিছুই খাইব না। কাজেই মাতা সুযোগের অপেক্ষায় রহিলেন যে, লোকদের চলাচল বন্ধ হইয়া যাক কারণ আবার কেহ দেখিয়া ফেলিলে কষ্ট দিতে পারে। যখন রাত্র গভীর হইয়া গেল। তখন আবু বকর রদিয়াল্লহু আ’নহু কে লইয়া রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমতে আরকাম রদিয়াল্লহু আ’নহু এর বাড়িতে পৌঁছিলেন। হযরত আবু বকর রদিয়াল্লহু আ’নহু রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম কে জড়াইয়া ধরিলেন। রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামও তাঁহাকে জড়াইয়া ধরিয়া কাঁদিলেন। সমস্ত মুসলমানগণও কাঁদিতে লাগিলেন। কেননা আবু বকর রদিয়াল্লহু আ’নহু এর অবস্থা সহ্য করিবার মত ছিল না। অতঃপর আবু বকর রদিয়াল্লহু আ’নহু আবেদন করিলেন যে, ইনি আমার মাতা আপনি তাঁহার জন্য হিদায়াতের দুআ করুন এবং তাঁহাকে ইসলামের তাবলীগও করুন। রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম প্রথমে দুআ করিলেন অতঃপর তাঁহাকে ইসলাম গ্রহণের জন্য উৎসাহ দিলেন। তিনি তৎক্ষনাৎ মুসলমান হইয়া গেলেন। (খামীস)

ফায়দাঃ সুখ-শান্তি ও আনন্দের সময় মুহাব্বাতের দাবীদার অসংখ্য পাওয়া যায় কিন্তু প্রকৃত মুহাব্বাত উহাই যাহা বিপদ ও কষ্টের সময়েও অটুট থাকে।

ফাযায়েলে আমাল (দারুল কিতাব, অক্টোবর ২০০১) পৃষ্ঠা ৮৪৯-৮৫১

রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তেকালে হযরত উ’মার রদিয়াল্লহু আ’নহু এর শোকাবেগ

হযরত উ’মার রদিয়াল্লহু আ’নহু এর অতুলনীয় শক্তি, সাহস, বীরত্ব ও বাহাদুরী যাহা আজ সাড়ে তেরশত বৎসর পরও বিশ্বব্যাপী প্রসিদ্ধ হইয়া আছে। আর ইসলামের প্রকাশ তাঁহার ইসলাম গ্রহণ করার কারণেই হইয়াছে। কেননা ইসলাম গ্রহণের পর স্বীয় ইসলামকে গোপন রাখা বরদাশত করেন নাই। রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের সহিত তাঁহার মুহাব্বাতের একটি ক্ষুদ্র দৃষ্টান্ত এই যে, এত বাহাদুরী সত্ত্বেও রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তেকালের অবস্থা সহ্য করতে পারেন নাই। অত্যন্ত অস্থির ও পেরেশান অবস্থায় খোলা তরবারী হাতে দাঁড়াইয়া গেলেন এবং বলিলেন, যে ব্যক্তি বলিবে রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম ইন্তেকাল করিয়া গিয়াছেন তাহার গর্দান উড়াইয়া দিব। রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম তো আপন রবের নিকট তাশরীফ নিয়া গেছেন যেমন হযরত মূসা আ’লাইহিস সালাম তূর পাহাড়ে তশরীফ লইয়া গিয়াছিলেন এবং শীঘ্রই রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম ফিরিয়া আসিবেন। এবং ঐ সমস্ত লোকদের হাত পা কাটিয়া দিবেন যাহারা তাঁহার ইন্তেকালের মিথ্যা খবর রটাইতেছে। হযরত উ’সমান রদিয়াল্লহু আ’নহু একেবারে নির্বাক ছিলেন দ্বিতীয় দিন পর্যন্ত কোন কথাই তাঁহার মুখ হইতে বাহির হয় নাই। চলাফেরা করিতেন কিন্তু কোন কথা বলিতেন না। হযরত আ’লী রদিয়াল্লহু আ’নহু নীরব ও নির্বাক বসিয়া ছিলেন। দেহে যেন স্পন্দনও ছিল না। একমাত্র হযরত আবু বকর রদিয়াল্লহু আ’নহু এর মধ্যেই দৃঢ়তা ছিল। তিনি সেই সময়ে পাহাড়তুল্য সমস্যার মুকাবিলা করিলেন নিজের সেই মুহাব্বাত সত্ত্বেও যাহা পূর্ববর্তী ঘটনায় বর্ণিত হইয়াছে। অত্যন্ত শান্তভাবে আসিয়া প্রথমে রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের কপাল মুবারকে চুম্বন করিলেন। অতঃপর বাহিরে আসিয়া উ’মার রদিয়াল্লহু আ’নহু কে বলিলেন, বসিয়া যাও। তারপর খুতবা পাঠ করিলেন, যাহার সারমর্ম এই ছিল, যে ব্যক্তি মুহা’ম্মাদ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের পুজা করে সে যেন জানিয়া রাখে যে, তাঁহার ইন্তেকাল হইয়া গিয়াছে। আর যে ব্যক্তি আল্লহ তায়া’লার ইবাদাত করে সে যেন জানিয়া রাখে যে, আল্লহ তায়া’লা জীবিত আছেন এবং চিরকাল থকিবেন। অতঃপর কালামে পাকের এই আয়াত وَمَا مُحَمَّدٌ إِلاَّ رَسُولٌ قَدْ خَلَتْ مِن قَبْلِهِ শেষ পর্যন্ত তেলাওয়াত করিলেন। (খামীস)

মুহা’ম্মাদ (সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) তো রসূল মাত্র (তিনি তো খোদা নহেন যে তাঁহার মৃত্যু আসিতে পারে না।) যদি তাঁহার ইন্তেকাল হইয়া যায় অথবা তিনি শহীদও হইয়া যান তবে কি তোমরা উল্টা দিকে ফিরিয়া যাইবে! আর যে ব্যক্তি উল্টা দিকে ফিরিয়া যাইবে যে আল্লহ তায়া’লার কোন ক্ষতি করিবে না। (নিজেরই ক্ষতি করিবে) আল্লহ তায়া’লা অতিসত্বর কৃতজ্ঞ বান্দাদিগকে প্রতিদান দিবেন। (সূরা আল ইমরনঃ ১৪৪) (বয়ানুল কুরআন)

ফায়দাঃ যেহেতু আল্লহ তায়া’লা হযরত আবু বকর সিদ্দীক রদিয়াল্লহু আ’নহু এর দ্বারা খিলাফাতের গুরুত্বপূর্ণ কাজ লইবেন তাই সেই সময়ে এই অবস্থাটিই তাঁহার উপযোগী ছিল। এই কারণেই সেই পরিস্থিতিতে হযরত আবু বকর সিদ্দীক রদিয়াল্লহু আ’নহু এর মধ্যে যতটুকু ধৈর্য্য ও দৃঢ়তা ছিল তাহা আর কাহারও মধ্যে ছিল না। সেই সঙ্গে মীরাস অর্থাৎ উত্তরাধিকার, দাফন ইত্যাদি বিষয়ে ঐ সময়ের উপযোগী মাসায়ালা যে পরিমাণ সিদ্দীকে আকবরের রদিয়াল্লহু আ’নহু জানা ছিল সামগ্রিক ভাবে আর কাহারও জানা ছিল না। যেমন রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের দাফন নিয়ে মতানৈক্য দেখা দিল যে, মক্কা মুকাররমায় দাফন করা হইবে নাকি মাদীনা মুনাওয়ারায়, নাকি বায়তুল মাকদাসে। তখন আবু বকর সিদ্দীক রদিয়াল্লহু আ’নহু বলিলেন, আমি রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম হইতে শুনিয়াছি নবীর কবর ঐ জায়গায়ই হয় যেখানে তাঁহার ইন্তেকাল হয়। অতএব যেখানে তাঁহার ইন্তেকাল হইয়াছে সেখানেই তাঁহার কবর খনন করা হউক। তিনি বলিলেন, আমি রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম হইতে শুনিয়াছি আমাদের (নবীগণের) কোন ওয়ারিস হয় না। আমরা যাহা কিছু রাখিয়া যাই তাহা সদকা স্বরূপ হইয়া থাকে।  তিনি বলিলেন, আমি রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম হইতে শুনিয়াছি যে, যে ব্যক্তি মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করে আর সে বেপরওয়াভাবে অবহেলা করিয়া অন্য কাহাকেও আমীর নিযুক্ত করে, তাহার উপরে লা’নত। রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম ইহাও বলিয়াছেন যে, কুরইশগণ এই বিষয়ের অর্থাৎ হুকুমাতের জিম্মাদার হইবে। ইত্যাদি, ইত্যাদি।

ফাযায়েলে আমাল (দারুল কিতাব, অক্টোবর ২০০১) পৃষ্ঠা ৮৫২-৮৫৩

রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের খবর জানার জন্য এক মহিলার অস্থিরতা

উহুদের যুদ্ধে মুসলমানগণ অনেক কষ্টও ভোগ করিয়াছেন এবং অনেক লোক শহীদও হইয়াছেন। এই মর্মান্তিক খবর মদীনা তইয়্যেবায় পৌঁছলে মহিলাগণ খবরা-খবর জানার জন্য ব্যাকুল হইয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া পড়েন। এক আনসারী মহিলা একটি দলের সহিত সাক্ষাত হইলে অত্যন্ত ব্যাকুল হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম কেমন আছেন? দলের মধ্য হইতে কেহ বলিল, তোমার পিতার ইন্তেকাল হইয়া গিয়াছে। তিনি ইন্নালিল্লাহ পড়িলেন এবং ব্যকুল হইয়া রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের খবর জিজ্ঞাসা করিলেন। ইতিমধ্যে কেহ তাঁহার স্বামীর, কেহ তাঁহার ছেলের, কেহ তাঁহার ভাইয়ের ইন্তেকালের কথা শুনাইল। ইহারা সকলেই শহীদ হইয়া গিয়াছিলেন। কিন্তু তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম কেমন আছেন? লোকেরা বলিল, রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম ভাল আছেন এবং আসিতেছেন। ইহাতে তিনি আশ্বস্ত হইতে না পারিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, আমাকে বলুন তিনি কোথায় আছেন।  লোকেরা ইশারা করিয়া বলিল, ঐ দলের মধ্যে আছেন। তিনি দৌঁড়াইয়া গেলেন এবং রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের দর্শন লাভে চক্ষু শীতল করিয়া বলিলেন, ইয়া রসুলুল্লহ! আপনাকে দেখার পর আমার সমস্ত মুসীবাত হালকা ও তুচ্ছ হইয়া গিয়াছে। এক বর্ণনায় আছে, তিনি রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের কাপড় ধরিয়া আরজ করিলেন, ইয়া রসুলুল্লহ! আমার পিতা-মাতা আপনার উপর কুরবান হউক, আপনি যখন জীবিত ও সুস্থ আছেন তখন আর কাহারও মৃত্যুর পরওয়া নাই। (খামীস)

ফায়দাঃ এই ধরনের বিভিন্ন ঘটনা ঐ সময়ে ঘটিয়াছে। তাই ঐতিহাসিকদের মধ্যে নামের ব্যাপারে মতভেদও রহিয়াছে। তবে সঠিক হইল এই ধরনের ঘটনা একাধিক মহিলার সহিত ঘটিয়াছে।

ফাযায়েলে আমাল (দারুল কিতাব, অক্টোবর ২০০১) পৃষ্ঠা ৮৫৩-৮৫৪

হুদাইবিয়াতে হযরত আবু বকর সিদ্দিক ও হযরত মুগীরা রদিয়াল্লহু আ’নহুমা এর আচরণ ও সাধারণ সাহাবীদের কর্মধারা

হিজরী ৬ষ্ঠ সনে যিলকদ মাসে হুদাইবিয়ার প্রসিদ্ধ যুদ্ধ সংঘটিত হয় যখন রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম উমরা পালনের উদ্দেশ্যে সাহাবাহ কেরাম রদিয়াল্লহু আ’নহুম দের এক বিরাট জামাত লইয়া রওয়ানা হইয়াছিলেন। মক্কার কাফেরদের নিকট যখন এই সংবাদ পৌঁছিল তখন তাহারা নিজেদের মধ্যে পরমর্শ করিয়া এই সিদ্ধান্ত করিল যে, মুসলমানদের মক্কার প্রবেশে বাধা দিতে হইবে। এই জন্য তাহারা বিরাট আকারে প্রস্তুতি গ্রহণ করিল এবং মক্কার বাহিরের লোকদিগকেও তাহাদের সহিত শরীক হওয়ার জন্য দাওয়াত দিল এবং বিরাট দল লইয়া মুকাবেলার জন্য প্রস্তুত হইল। যুল হুলাইফা নামক স্থান হইতে এক ব্যক্তিকে রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম খবর লওয়র জন্য পাঠাইলেন যিনি মক্কা হইতে বিস্তারিত অবস্থা জানিয়া উসফান নামক স্থানে রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের সহিত সাক্ষাত করিলেন। তিনি বলিলেন যে, মক্কাবাসীরা বিরাট আকারে মুকাবিলার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করিয়াছে এবং তাহাদের সাহায্যের জন্য বাহির হইতেও বহু লোক সংগ্রহ করিয়া রাখিয়াছে। রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবাহ কেরাম রদিয়াল্লহু আ’নহুমদের সহিত পরমর্শ করিলেন যে, এই পরিস্থিতিতে কি করা উচিত। এক পন্থা হইতে পারে, যে সমস্ত লোক বাহির হইতে সাহায্য করার জন্য গিয়াছে তাহাদের ঘরবাড়ির উপর হামলা করা, যখন তাহারা এই সংবাদ পাইবে মক্কা হইতে ফিরিয়া আসিবে। অন্যপন্থা হইল সোজা সামনের দিকে চলা। হযরত আবু বকর সিদ্দীক রদিয়াল্লহু আ’নহু বলিলেন, ইয়া রসুলুল্লহ! এই মুহুর্তে আপনি বাইতুল্লহর উদ্দেশ্যে আসিয়াছেন যুদ্ধ করার উদ্দেশ্য তো ছিলই না। তাই সামনের দিকে অগ্রসর হউন। তাহারা যদি আমাদিগকে বাধা দেয় তবে মুকাবিলা করিব, নতুবা নহে। রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম এই পরমর্শ গ্রহণ করিলেন এবং সামনের দিকে অগ্রসর হইলেন।

হুদাইবিয়া নামক জায়গায় পৌঁছিলে বুদাইল ইবনে ওরাকা খুযায়ী একদল লোকসহ আসিল এবং রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট জানাইল যে, কাফেররা কিছুতেই রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম কে মক্কায় প্রবেশ করিতে দিবে না। তাহারা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হইয়া আছে। রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলিলেন যে, আমরা যুদ্ধ করিতে আসি নাই। আমাদের উদ্দেশ্য কেবল উমরা করা। তাছাড়া দৈনন্দিন যুদ্ধ-বিগ্রহ কুরাইশদের বহু ক্ষতিগ্রস্থ করিয়াছে, সম্পূর্ণ ধ্বংস করিয়া দিয়াছে। তাহারা সম্মত হইলে আমি তাহাদের সহিত সন্ধি করিতে প্রস্তুত আছি। আমাদের ও তাহাদের মধ্যে এই বিষয়ে চুক্তি হইয়া যাক যে, তাহারা আমাদের পিছনে পড়িবে না আমিও তাহাদের পিছনে পড়িব না এবং আমাদের অন্যের সহিত বুঝাপড়া করিবার সু্যোগ দিক। আর যদি তাহারা কিছুতেই রাজী না হয়, তবে ঐ যাতের কসম যাহার হাতে আমার প্রাণ, আমি ততক্ষন পর্যন্ত তাহাদের সহিত যুদ্ধ করিব যতক্ষন পর্যন্ত ইসলাম বিজয়ী না হইবে অথবা আমার গর্দান বিছিন্ন না হইবে। বুদাইল বলিল আচ্ছা আমি আপনার এই পয়গাম তাহাদের নিকট পৌঁছাইয়া দিতেছি। সে ফিরিয়া গেল এবং যাইয়া পয়গাম পৌঁছাইল। কিন্তু কাফেররা রাজী হইল না। এমনিভাবে উভয় পক্ষ হইতে আসা যাওয়া চলিতে থাকিল। তন্মধ্যে একবার ওরওয়া ইবনে মাসঊ’দ সাকাফী কাফেরদের পক্ষ হইতে আসিলেন। তিনি তখনও মুসলমান হইয়াছিলেন না, পরে হইয়াছেন। রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম তাহার সহিতও একই আলোচনা করিলেন যাহা বুদাইলের সহিত করিয়াছিলেন। ওরওয়া বলিলেন, মুহা’ম্মাদ, (সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) আপনি যদি আরবদিগকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করিয়া দিতে চান তবে ইহা সম্ভব নহে। আপনি কি কখনও শুনিয়াছেন যে, আপনার পূর্বে এমন কোন ব্যক্তি অতীত হইয়াছে যে কিনা আরবদিগকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করিয়া দিয়াছে? আর যদি বিপরীত অবস্থা হয়, অর্থাৎ তাহারা যদি আপনার উপর বিজয়ী হয় তবে মনে রাখুন, আমি আপনার সহিত ভদ্র শ্রেণীর লোকজন দেখিতেছি না। এদিক সেদিকের নিম্নশ্রেণীর লোকজন আপনার সহিত আছে। বিপদের সময় সকলেই পালাইয়া যাইবে। হযরত আবু বকর রদিয়াল্লহু আ’নহু পাশে দাঁড়ানো ছিলেন। তিনি এই বাক্য শুনিয়া ক্রোধান্বিত হইলেন এবং বলিলেন, তুই গিয়া তোর মাবুদ লাতের লজ্জাস্থান চাট। আমরা কি রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট হইতে পালাইয়া যাইব? এবং তাঁহাকে একা ছাড়িয়া দিব? ওরওয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, এই ব্যক্তি কে? রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম ব্ললিনে, আবু বকর। তিনি আবু বকর রদিয়াল্লহু আ’নহু কে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, তোমার অতীত একটি অনুগ্রহ আমার উপর রহিয়াছে যাহার প্রতিদান আমি তোমাকে দিতে পারি নাই। যদি ইহা না হইত তবে তোমার এই গালির জবাব দিতাম। এই বলিয়া ওরওয়া পুনরায় রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের সহিত কথাবার্তায় মশগুল হইয়া গেলেন এবং আরবদের সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী কথাবার্তার সময় রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের দাড়ি মুবারকের দিকে হাত বাড়াইতেন। কেননা খোশামোদ করার সময় দাড়িতে হাত বুলাইয়া কথা বলা হইয়া থাকে। কিন্তু সাহাবাহ কেরাম রদিয়াল্লহু আ’নহুম ইহা কিভাবে সহ্য করিতে পারেন! ওরওয়ার ভাতিজা মুগীরা ইবনে শু’বা রদিয়াল্লহু আ’নহু মাথায় লৌহ শিরস্ত্রাণ করিয়া অস্ত্রসজ্জিত অবস্থায় পাশে দন্ডায়মান ছিলেন। তিনি তরবারীর বাট দ্বারা ওরওয়ার হাতে আঘাত করিয়া বুলিলেন, হাত দূরে রাখ। ওরওয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, এই লোকটি কে? রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলিলেন, মুগীরাওরওয়া বলিলেন, হে গাদ্দার! তোর গাদ্দারীর ফল আমি এখন পর্যন্ত ভুগিতেছি আর তোর এই ব্যবহার? (হযরত মুগীরা ইবনে শু’বা রদিয়াল্লহু আ’নহু ইসলাম গ্রহণের পূর্বে কয়েকজন কাফেরকে হত্যা করিয়া ছিলেন। উহার রক্তপণ ওরওয়া আদায় করিয়া ছিলেন। তিনি ঐ দিকে ইঙ্গিত করিলেন।) মোটকথা দীর্ঘ সময় রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের সহিত কথাবার্তা বলিতে থাকিলেন এবং সকলের দৃষ্টির অগোচরে সাহাবাহ কেরাম রদিয়াল্লহু আ’নহুমদের অবস্থাও পর্যবেক্ষন করিতে থাকিলেন।

অতঃপর ফিরিয়া গিয়া কাফেরদের নিকট বলিলেন, হে কুরইশ! আমি বড় বড় রাজা বাদশার দরবারে গিয়াছি। কিসরা, কাইসার ও নাজ্জাশীর দরবারেও গিয়াছি। তাহাদের রীতিনীতি দেখিয়াছি। আল্লহর কসম! আমি কোন বাদশাকে দেখি নাই যে, তাহার লোকেরা তাহার এইরূপ সম্মান করে, যেইরূপ সম্মান মুহা’ম্মাদ (সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর লোকেরা তাঁহার সম্মান করে। যদি তিনি থুথু ফেলেন যাহার হাতে পড়িয়া যায়, সে উহা শরীরে ও চেহারায় মাখিয়া লয়। যে কথা মুহা’ম্মাদ (সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর মুখ হইতে বাহির হয় উহা পালন করার জন্য সকলেই ঝাঁপাইয়া পড়ে। তাঁহার অযুর পানি পরস্পর কাড়াকাড়ি করিয়া বন্টন করিয়া লয়, মাটিতে পড়িতে দেয় না। যদি কেহ পানির ফোঁটা না পায় তবে অন্যের ভিজা হাতে হাত মলিয়া নিজের মুখে মাখিয়া লয়। তাঁহার সামনে অত্যন্ত নিচু আওয়াজে কথা বলে, উচ্চ আওয়াজে কথা বলে না। আদবের কারণে তাঁহার দিকে চক্ষু উঠাইয়া দেখে না। যদি তাঁহার কোন দাঁড়ি বা চুল ঝরিয়া পড়ে তবে বরকতের জন্য উহা উঠাইয়া লয় এবং সম্মান করে। মোটকথা আমি কোন দলকেই আপন মনিবের সহিত এত মুহাব্বাত করিতে দেখি নাই, যত মুহাব্বাত মুহা’ম্মাদ (সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর লোকজন তাঁহার করিয়া থাকে।

এই অবস্থা চলাকালে মুহা’ম্মাদ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত উ’সমান রদিয়াল্লহু আ’নহু কে নিজের পক্ষ হইতে দূত হিসাবে মক্কার সরদারদের নিকট পাঠাইলেন। হযরত উ’সমান রদিয়াল্লহু আ’নহু মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও মক্কায় তাঁহার যথেষ্ট সম্মান ছিল এবং তাঁহার ব্যাপারে তেমন আশংকা ছিল না। এই কারণে রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁহাকে নির্বাচন করিয়াছিলেন। তিনি মক্কা গেলেন। সাহাবীদের (রদিয়াল্লহু আ’নহুম) ঈর্ষা হইল যে, উ’সমান তো আনন্দের সহিত কা’বাঘর তাওয়াফ করিতেছে। রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলিলেন, আমি আশা করি না যে, সে আমাকে ছাড়া তাওয়াফ করিবে। সুতরাং হযরত উ’সমান রদিয়াল্লহু আ’নহু যখন মক্কায় পৌঁছিলেন তখন আবান ইবনে সাঈ’দ তাঁহাকে নিরাপত্তা দিল এবং বলিল যে, যেখানে ইচ্ছা চলাফেরা করিতে পার, তোমাকে কেহ বাধা দিতে পারিবে না। হযরত উ’সমান রদিয়াল্লহু আ’নহু আবু সুফিয়ান ও মক্কার অন্যান্য সরদারদের সহিত সাক্ষাত করিতে থাকিলেন এবং রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের পয়গাম পৌঁছাইতে থাকিলেন। যখন ফিরিয়া আসিতে লাগিলেন তখন কাফিররা নিজেরাই অনুরোধ করিল যে, তুমি মক্কায় আসিয়াছ সুতরাং তাওয়াফ করিয়া যাও। তিনি জবাব দিলেন যে, ইহা আমার দ্বারা সম্ভব নয় যে, রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম কে বাধা দেওয়া হইয়াছে আর আমি তাওয়াফ করিব। কুরইশরা এই উত্তর শুনিয়া ক্ষিপ্ত হইয়া উ’সমান রদিয়াল্লহু আ’নহু কে আটক করিয়া রাখিল। মুসলমানদের নিকট এই সংবাদ পৌঁছিল যে, উ’সমান রদিয়াল্লহু আ’নহু কে শহীদ করিয়া দেওয়া হইয়াছে। ইহার উপর রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবাহ কেরাম রদিয়াল্লহু আ’নহুম দের নিকট হইতে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত লড়াই করিয়া যাওয়ার বাইয়াত গ্রহণ করিলেন। কাফেররা এই সংবাদ শুনিয়া ঘাবড়াইয়া গেল এবং উ’সমান রদিয়াল্লহু আ’নহু কে সঙ্গে সঙ্গে ছাড়িয়া দিল। (খামীস)

ফায়দাঃ এই ঘটনায় হযরত আবু বকর রদিয়াল্লহু আ’নহু এর উক্তি, হযরত মুগীরা রদিয়াল্লহু আ’নহু কতৃক আঘাত করা, সামগ্রিক ভাবে সাহাবাহ কেরাম রদিয়াল্লহু আ’নহুম দের আচরণ যাহা ওরওয়া গভীর ভাবে লক্ষ্য করিয়াছে, হযরত উ’সমান রদিয়াল্লহু আ’নহু কতৃক তাওয়াফ করিতে অস্বীকার করা–প্রত্যেকটি বিষয় রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি সাহাবাহ কেরাম রদিয়াল্লহু আ’নহুদের  অকৃত্রিম ও পরম ভালবাসার পরিচয় দেয়। উল্লিখিত ঘটনায় যে বাইয়াতের কথা আলোচিত হইয়াছে উহাকে ‘বায়াতুশ-শাজারা’ বলা হয়। কুরআন পাকেও উহার উল্লেখ রহিয়াছে। আল্লহ তায়া’লা সূরা ফাতহের لَقَدْ رَضِيَ اللَّهُ عَنِ الْمُؤْمِنِينَ-الاية ইহা উল্লেখ করিয়াছেন। পূর্ণ আয়াত তরজমাসহ পরিশিষ্টে আসিবে।

ফাযায়েলে আমাল (দারুল কিতাব, অক্টোবর ২০০১) পৃষ্ঠা ৮৫৪-৮৫৮