Posts Tagged ‘আখেরাত’

সাহাবাহ কেরাম রদিয়াল্লহু আ’নহুমদের সহিত ব্যবহার ও তাঁহাদের সংক্ষিপ্ত গুণাবলী

সাহাবাহ কেরাম রদিয়াল্লহু আ’নহুমদের কয়েকটি ঘটনা নমুনা স্বরূপ লেখা হইয়াছে, নতুবা তাঁহাদের অবস্থা বড় বড় কিতাবেও সংকুলান হইবে না। উর্দুতে এই বিষয়ের উপর যথেষ্ট কিতাবাদী পাওয়া যায়। কয়েকটি মাস হইল এই কিতাবটি লিখিতে শুরু করিয়াছিলাম, কিন্তু মাদ্রাসার ব্যস্ততার এবং অন্যান্য সাময়িক অসুবিধার কারণে বাধাগ্রস্থ হইয়াছি। এখন এই কয়েকটি পৃষ্ঠা লিখিয়াই শেষ করিতেছি, যেন যাহা লেখা হইয়াছে তাহা উপকারী হয়।

পরিশেষে একটি গুরুত্বপুর্ণ বিষয় সম্পর্কে সতর্ক করা জরুরী মনে করিতেছি। আর তাহা এই যে, এই উচ্ছৃঙ্খলতার যুগে যেই ক্ষেত্রে আমাদের মুসলমানদের মধ্যে দ্বীনের অন্যান্য বহু বিষয়ে ত্রুটি-বিচ্যুতি এবং উপেক্ষা পরিলক্ষিত হইতেছে সেইক্ষেত্রে সাহাবাহ কেরাম রদিয়াল্লহু আ’নহুমদের হক এবং তাঁহাদের আদাব এহতেরামের ব্যাপারেও সীমাহীন ত্রুটি হইতেছে। বরং ইহা অপেক্ষাও মারাত্মক হইল দ্বীনের ব্যাপারে উদাসীন কিছু লোক তো তাঁহাদের শানে বেয়াদবী পর্যন্ত করিয়া বসে। অথচ সাহাবাহ কেরাম রদিয়াল্লহু আ’নহুম হইলেন দ্বীনের বুনিয়াদ। সর্বপ্রথম তাঁহারাই দ্বীনের প্রচার-প্রসার করিয়াছেন। সারা জীবন চেষ্টা করিয়াও আমরা তাহাদের হক আদায় করিতে পারিব না। আল্লহ তায়া’লা আপন অনুগ্রহে তাঁহাদের প্রতি লাখো রহমত নাযিল করুন। কেননা তাঁহার রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের কাছ থেকে দ্বীন হাসিল করিয়া আমাদের পর্যন্ত পৌঁছাইয়াছেন। তাই এই কিতাবে কাযী ইয়ায রহমাতুল্লহ আ’লাইহি এর শিফা নামক কিতাবের একটি পরিচ্ছেদের সংক্ষিপ্ত তরজমা যাহা এই ক্ষেত্রে উপযোগী, উল্লেখ করিতেছি এবং ইহার উপরেই এই পুস্তিকা সমাপ্ত করিতেছি।

তিনি বলেন, রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি ভক্তি ও সম্মান প্রদর্শনেরই অন্তর্ভূক্ত হইতেছে তাঁহার সাহাবাহ রদিয়াল্লহু আ’নহুমগণের সম্মান করা, তাঁহাদের হক জানা, তাঁহাদের অনুসরণ করা, তাঁহাদের প্রশংসা করা, তাঁহাদের জন্য মাগফেরাতের দোয়া করা, তাঁহাদের পারস্পরিক মতানৈক্য সম্পর্কে আলোচনা না করা। ঐতিহাসিক, শিয়া, বিদয়াতী এবং জাহেল বর্ণনাকারীদের ঐ সমস্ত বর্ণনার প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করা, যাহা তাঁহাদের সম্পর্কে অবমাননাকর। যদি এই ধরণের কোন বর্ণনা কানে আসে তবে উহার কোন ভাল ব্যাখ্যা করিবে এবং কোন ভাল অর্থ নির্ধারণ করিবে যাহা তাঁহাদের শানের উপযোগী হয়। তাঁহাদের কোন দোষ বর্ণনা করিবে না। বরং তাঁহাদের গুণাবলী বর্ণনা করিবে এবং দোষনীয় বিষয়ে নিরবতা অবলম্বন করিবে। যেমন রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করিয়াছেন, যখন আমার সাহাবীদের (মন্দ) আলোচনা হয় তখন চুপ থাক।

সাহাবাহ কেরাম রদিয়াল্লহু আ’নহুমদের মর্যাদার কথা কুরআন ও হাদিসে অধিক পরিমাণে বর্ণিত হইয়াছে। আল্লহ তায়া’লা এরশাদ করেন–

مُّحَمَّدٌ رَّسُولُ اللَّـهِ ۚ وَالَّذِينَ مَعَهُ أَشِدَّاءُ عَلَى الْكُفَّارِ رُحَمَاءُ بَيْنَهُمْ ۖ تَرَاهُمْ رُكَّعًا سُجَّدًا يَبْتَغُونَ فَضْلًا مِّنَ اللَّـهِ وَرِضْوَانًا ۖ سِيمَاهُمْ فِي وُجُوهِهِم مِّنْ أَثَرِ السُّجُودِ ۚ ذَٰلِكَ مَثَلُهُمْ فِي التَّوْرَاةِ ۚ وَمَثَلُهُمْ فِي الْإِنجِيلِ كَزَرْعٍ أَخْرَجَ شَطْأَهُ فَآزَرَهُ فَاسْتَغْلَظَ فَاسْتَوَىٰ عَلَىٰ سُوقِهِ يُعْجِبُ الزُّرَّاعَ لِيَغِيظَ بِهِمُ الْكُفَّارَ ۗ وَعَدَ اللَّـهُ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ مِنْهُم مَّغْفِرَةً وَأَجْرًا عَظِيمًا

অর্থঃ মুহাম্মাদ আল্লহর রসূল আর যাহারা তাঁহার সঙ্গে আছে তাহারা কাফিরদের মোকাবেলায় অত্যন্ত কঠোর আর পরস্পরে সদয়। হে শ্রোতা! তুমি তাহাদিগকে দেখিতে পাইবে তাহারা কখনও রুকু অবস্থায় আছে কখনও সিজদারত আছে এবং আল্লহ তায়া’লার অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টির তালাশে লিপ্ত রহিয়াছে। তাহাদের বন্দেগীর আলামত তাঁহাদের চেহারার উপর সিজদার কারণে পরিস্ফুট হইয়া আছে। তাঁহাদের এই সবগুণ তাওরাতে রহিয়াছে আর ইঞ্জিলে তাঁহাদের এই দৃষ্টান্ত বর্ণনা করা হইয়াছে, যেমন শস্য যাহা প্রথমে আপন অঙ্কুর বাহির করিল, অতঃপর উহা আপন অঙ্কুরকে শক্তিশালী করিল, অর্থাৎ উক্ত শস্য মোটা তাজা হইল। তারপর উহা আরও মোটা-তাজা হইল অতঃপর আপন কান্ডের উপর সোজা দাঁড়াইয়া গেল, ফলে কৃষকের আনন্দবোধ হইতে লাগিল। (তদ্রূপ সাহাবাহ রদিয়াল্লহু আ’নহুমদের মধ্যে প্রথমে দুর্বলতা ছিল, অতঃপর দিন দিন তাঁহাদের শক্তি বৃদ্ধি পাইল। আল্লহ তায়া’লা সাহাবাহদের এইরূপ ক্রমোন্নতি দান করিলেন) যেন কাফেরদিগকে হিংসার আগুনে বিদগ্ধ করেন। আর আখেরাতে আল্লহ তায়া’লা ঐ সকল ব্যক্তিদের সহিত যাহারা ঈমান আনিয়াছে এবং নেক আমাল করিতেছে ক্ষমা এবং বিরাট প্রতিদানের ওয়াদা করিয়া করিয়াছেন। (সূরা ফাতহঃ ২৯)

তাওরাত শব্দের উপর যদি আয়াত শেষ হয় তবে এরূপ তরজমা হইবে যাহা উপরে করা হইয়াছে।আর আয়াতের পার্থক্যের কারণে অর্থেও পার্থক্য হইয়া যাইবে, যাহা তাফসীরের কিতাব সমূহ হইতে বুঝা যাইতে পারে। উক্ত সূরারই অপর জায়গায় এরশাদ হইয়াছে–

لَّقَدْ رَضِيَ اللَّـهُ عَنِ الْمُؤْمِنِينَ إِذْ يُبَايِعُونَكَ تَحْتَ الشَّجَرَةِ فَعَلِمَ مَا فِي قُلُوبِهِمْ فَأَنزَلَ السَّكِينَةَ عَلَيْهِمْ وَأَثَابَهُمْ فَتْحًا قَرِيبًا

অর্থঃ নিশ্চয়ই আল্লহ তায়া’লা ঐ সকল মুসলমানদের প্রতি সন্তুষ্ট হইয়াছেন (যাহারা আপনার সফর সঙ্গী), যখন তাঁহারা আপনার সহিত গাছের নিচে অঙ্গীকার করিতেছিল এবং তাঁহাদের অন্তরে যাহা কিছু (ইখলাস ও মজবুতি) ছিল উহাও আল্লহ তায়া’লার জানা ছিল, আর আল্লহ তায়া’লা তাঁহাদের অন্তরে প্রশান্তি সৃষ্টি করিয়া দিয়াছিলেন এবং তাহাদিগকে একটি নিকটবর্তী বিজয় দান করিলেন। (ইহা দ্বারা খায়বরের বিজয় কে বুঝানো হইয়াছে, যাহা উহার একেবারে নিকটবর্তী সময়ে হইয়াছে) আর প্রচুর গনিমতও দান করিলেন। আল্লহ তায়া’লা বড় যবরদস্ত হিকমাতওয়ালা। (সূরা ফাতহঃ ১৮)

সাহাবাহ কেরাম রদিয়াল্লহু আ’নহুমদের ব্যাপারে আল্লহ তায়া’লা এরশাদ করেন–

مِّنَ الْمُؤْمِنِينَ رِجَالٌ صَدَقُوا مَا عَاهَدُوا اللَّـهَ عَلَيْهِ ۖ فَمِنْهُم مَّن قَضَىٰ نَحْبَهُ وَمِنْهُم مَّن يَنتَظِرُ ۖ وَمَا بَدَّلُوا تَبْدِيلًا

অর্থঃ ঐ সকল মুমিনদের মধ্যে কিছু লোক এমন রহিয়াছে যাহারা আল্লহর সহিত যে ওয়াদা করিয়াছিল উহাতে সত্য প্রমানিত হইয়াছে। অতঃপর তাহাদের মধ্যে কিছু লোক এমন রহিয়াছে যাহারা আপন মানত পূর্ণ করিয়াছে (অর্থাৎ শহীদ হইয়া গিয়াছে।) আর কিছু তাহাদের মধ্য হইতে উহার জন্য আগ্রহী এবং অপেক্ষায় আছে (এখনও শহীদ হয় নাই) এবং নিজেদের ইচ্ছার মধ্যে  কোনরূপ পরিবর্তন ও রদ-বদল ঘটায় নাই। (সূরা আহযাবঃ ২৩)

এক জায়গায় আল্লহ তায়া’লা এরশাদ করিয়াছেন–

وَالسَّابِقُونَ الْأَوَّلُونَ مِنَ الْمُهَاجِرِينَ وَالْأَنصَارِ وَالَّذِينَ اتَّبَعُوهُم بِإِحْسَانٍ رَّضِيَ اللَّـهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ وَأَعَدَّ لَهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي تَحْتَهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا ۚ ذَٰلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ

অর্থঃ যে সমস্ত মুহাজির এবং আনসারগণ (ঈমান আনয়নের ক্ষেত্রে সকল উম্মত হইতে) অগ্রবর্তী আর যে সকল লোক ইখলাসের সহিত তাঁহাদের অনুগামী হইয়াছে, আল্লহ তায়া’লা তাহাদের সকলের প্রতি সন্তুষ্ট হইয়াছেন আর তাহারা সকলে আল্লহ তায়া’লার প্রতি সন্তুষ্ট হইয়াছে আর আল্লহ তায়া’লা এমন বাগান সমূহ তৈয়ার করিয়া রাখিয়াছেন যেইগুলির তলদেশ দিয়া নহর প্রবাহিত হইবে যাহাতে তাহারা চিরকাল থাকিবে এবং ইহা বড় কামিয়াবী। (সূরা তওবাহঃ ১০০)

উল্লেখিত আয়াতসমূহে আল্লহ তায়া’লা সাহাবাহ কেরাম রদিয়াল্লহু আ’নহুমদের প্রশংসা এবং তাঁহাদের প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশ করিয়াছেন।

অনুরূপ ভাবে বিভিন্ন হাদীসেও অত্যধিক পরিমাণে তাঁহাদের গুণাবলী বর্ণিত হইয়াছে। রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম ফরমাইয়াছেন আমার পর আবু বকর রদিয়াল্লহু আ’নহুউ’মার রদিয়াল্লহু আ’নহু এর অনুসরণ করিও। এক হাদীসে এরশাদ করিয়াছেন, আমার সাহবাহগণ তারকার ন্যায়, তোমরা যাহারই অনুসরণ করিবে হেদায়াত প্রাপ্ত হইবে।

উল্লেখিত হাদীস সম্পর্কে মুহাদ্দিসগণে আপত্তি রহিয়াছে। এইজন্যই কাযী ইয়ায রহমাতুল্লহ আ’লাইহি উক্ত হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন বলিয়া তাঁহার উপর প্রশ্ন তোলা হইয়াছে। তবে মোল্লা আ’লী ক্বারী রহমাতুল্লহ আ’লাইহি লিখিয়াছেন, হইতে পারে একাধিক সনদের মাধ্যমে বর্ণিত হওয়ার কারণে উক্ত হাদীস তাঁহার নিকট নির্ভরযোগ্য অথবা ফযীলত ও মর্যাদার সম্পর্কিত হওয়ার কারণে তিনি উল্লেখ করিয়াছেন। (কেননা ফযীলতের হাদীস সামান্য দুর্বলতা সত্ত্বেও উল্লেখ করা হইয়া থাকে।)

হযরত আনাস রদিয়াল্লহু আ’নহু বলেন, রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম ফরমাইয়াছেন, আমার সাহাবীদের দৃষ্টান্ত হইল খাদ্যের মধ্যে লবনের ন্যায় যেমন খাদ্য লবন ব্যতীত সুস্বাদু হইতে পারে না।

রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম ইহাও এরশাদ করিয়াছেন, আমার সাহাবীগনের ব্যাপারে আল্লহ কে ভয় কর। তাঁহাদিগকে সমালোচনার পাত্র বানাইও না। যে ব্যক্তি তাঁহাদের প্রতি মুহাব্বাত রাখে, আমার মুহাব্বাতের কারণেই তাঁহাদের প্রতি মুহাব্বাত রাখে। আর যে ব্যক্তি তাঁহাদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে যে আমার প্রতি বিদ্বেষ পোষণের কারণেই তাঁহাদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে। যে তাঁহাদিগকে কষ্ট দিল সে আমাকে কষ্ট দিল, আর যে আমাকে কষ্ট দিল সে আল্লহকে কষ্ট দিল। আর যে আল্লহকে কষ্ট দেয় সে অতিসত্বর পাকড়াও হবে।

রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম ইহাও এরশাদ করিয়াছেন যে, আমার সাহাবীগণকে গালি দিও না। তোমাদের কেহ যদি উহুদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণ খরচ করে তবে উহা সওয়াবের দিক হইতে সাহাবাদের এক মুদ বা আধা মুদের সমান হইতে পারে না। (এক মুদ প্রায় এক সেরের সমান)

রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করিয়াছেন যে ব্যক্তি সাহাবাহদিগকে গালি দিবে তাহার উপর আল্লহ তায়া’লার লানত, ফেরেশতাদের লানত এবং সমস্ত মানুষের লানত। তাহার না ফরয কবুল হইবে না নফল।

রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করিয়াছেন, আল্লহ তায়া’লা নবীগণ ব্যতীত অন্য সমস্ত মানুষ হইতে আমার সাহাবীদিগকে বাছাই করিয়াছেন। তাঁহাদের মধ্য হইতে চারজনকে স্বাতন্ত্র্য দান করিয়াছেন–আবু বকর, উ’মার, উ’সমান, আ’লী রদিয়াল্লহু আ’নহুম। তাঁহাদিগকে আমার সাহাবীগণের মধ্যে শেষ্ঠ সাব্যস্ত করিয়াছেন।

আইয়ূব সাখতিয়ানী রহমাতুল্লহ আ’লাইহি বলেন, যে ব্যক্তি আবু বকর রদিয়াল্লহু আ’নহু কে ভালবাসিল সে দ্বীনকে সোজা করিল, যে ব্যক্তি উ’মার রদিয়াল্লহু আ’নহু কে ভালবাসিল সে দ্বীনের সুস্পষ্ট রাস্তা পাইল, যে উ’সমান রদিয়াল্লহু আ’নহু কে ভালবাসিল সে আল্লহ তায়া’লার নূর দ্বারা আলোকিত হইল আর যে আ’লী রদিয়াল্লহু আ’নহু কে ভালবাসিল সে দ্বীনের মজবুত রশি ধারণ করিল। যে সাহাবাহ দের প্রশংসা করিল সে মুনাফিকী হইতে মুক্ত আর যে সাহাবাহ দের সহিত বেয়াদবী করে সে বিদয়াতী, মুনাফিক ও সুন্নত বিরোধী। আমার আশংকা হয় যে তাহার কোন আমাল কবুল হইবে না, যে পর্যন্ত তাঁহাদের সকলের প্রতি মুহাব্বাত না রাখিবে এবং তাঁহাদের সম্পর্কে দিল সাফ না হইবে।

এক হাদীসে আছে, রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন, হে লোকেরা! আমি আবু বকরের প্রতি সন্তুষ্ট তোমরা তাঁহার মর্যাদা বুঝিও। আমি উ’মার, আ’লী, উ’সমান, তলহা, যুবাইর, সা’দ, সাঈ’দ, আবদুর রহমান ইবনে আওফ এবং আবু উ’বাইদাহ রদিয়াল্লহু আ’নহুম এর প্রতি সন্তুষ্ট তোমরা তাঁহাদের মর্যাদা বুঝিও। হে লোকেরা! আল্লহ তায়া’লা বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদিগকে এবং হুদায়বিয়ার যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদিগকে ক্ষমা করিয়া দিয়াছেন। তোমরা আমার সাহাবীদের ব্যাপারে আমার প্রতি লক্ষ্য রাখিবে আর ঐ সমস্ত লোকদের ব্যাপারে যাহাদের কন্যারা আমার বিবাহের মধ্যে আছে এবং আমার কন্যারা যাহাদের বিবাহের মধ্যে আছে। এমন যেন না হয় যে, তাঁহারা তোমাদের বিরুদ্ধে কিয়ামাতের দিন জুলুমের অভিযোগ করিয়া বসে। কেননা উহা মাফ করা হইবে না।

এক জায়গায় এরশাদ করিয়াছেন, আমার সাহাবী এবং আমার জামাতাদের ব্যাপারে আমার দিকে খেয়াল রাখিও। যে ব্যক্তি তাঁহাদের ব্যাপারে আমার প্রতি খেয়াল করিবে আল্লহ তায়া’লা তাহাকে দুনিয়া আখেরাতে হিফাযত করিবেন আর যে ব্যক্তি তাঁহাদের ব্যাপারে আমার প্রতি খেয়াল করিবে না আল্লহ তায়া’লা তাহার দায়িত্ব হইতে মুক্ত, অসম্ভব নয় যে সে কোন আযাবে পাকড়াও হইয়া যাইবে।

রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম হইতে ইহাও বর্ণিত আছে যে, যে ব্যক্তি সাহাবীদের ব্যাপারে আমার খেয়াল করিবে কিয়ামাতের দিন আমি তাহার হিফাযতকারী হইব।

এক জায়গায় এরশাদ করিয়াছেন, যে ব্যক্তি আমার সাহাবীদের ব্যাপারে আমার খেয়াল করিবে সে আমার নিকট হাউজে কাউসারে পৌঁছিতে পারিবে আর যে আমার সাহাবীদের ব্যাপারে আমার খেয়াল করিবে না সে আমার নিকট হাউজ পর্যন্ত পৌঁছিতে পারিবে না এবং দূর হইতে শুধু দেখিতে হইবে।

সাহল ইবনে আ’ব্দুল্লহ রহমাতুল্লহ আ’লাইহি বলেন, যে ব্যক্তি রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবীদের সম্মান করে না সে রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি ঈমানই আনে নাই।

আল্লহ তায়া’লা আপন অনুগ্রহে তাঁহার শাস্তি এবং আপন মাহবুবের অসন্তুষ্টি হইতে আমাকে, আমার বন্ধু-বান্ধবকে, আমার হিতাকাঙ্খীদেরকে, আমার সহিত সাক্ষাতকারীদেরকে, আমার শাইখ ও ছাত্রদিগকে ও সমস্ত মুমিনে-মুসলমানদিগকে রক্ষা করুন এবং আমাদের অন্তরসমূহকে সাহাবাহ কেরাম রদিয়াল্লহু আ’নহুম দের মুহাব্বাত দ্বারা পরিপূর্ণ করিয়া দিন—আমীন।

যাকারিয়া উফিয়া আ’নহু
মুকীম, মাদ্রাসা মাযাহেরে উলুম, সাহারানপুর
১২ই শাওয়াল, ১৩৫৭ হিঃ, সোমবার।

ফাযায়েলে আমাল (দারুল কিতাব, অক্টোবর ২০০১) পৃষ্ঠা ৮৭১-৮৭৬

দাওয়াতের কাজ একটি লাভজনক ব্যবসা

এই মূলনীতিগুলির সংক্ষিপ্ত নকশা আপনাদের সামনে আসিয়া গিয়াছে এবং ইহার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তাও আপনাদের পরিষ্কার হইয়া গিয়াছে। কিন্তু এখন দেখিবার বিষয় যে, বর্তমান দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, পেরেশানী ও অশান্তির মধ্যে উক্ত কাজ আমাদিগকে কি পরিমাণ পথ দেখাইতে পারিবে এবং কি পরিমাণ আমাদের সমস্যা দূর করিতে পারিবে। ইহার জন্য আমাদিগকে পুনরায় কুরআন কারীমের দিকে মনোনিবেশ করিতে হইবে। কুরআন কারীমে আমাদের এই চেষ্টা-মেহনতকে ‘লাভজনক ব্যবসা’ বলিয়া আখ্যায়িত করিয়াছে এবং ইহার প্রতি এই ভাবে উৎসাহিত করিয়াছেঃ

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا هَلْ أَدُلُّكُمْ عَلَىٰ تِجَارَةٍ تُنجِيكُم مِّنْ عَذَابٍ أَلِيمٍ
تُؤْمِنُونَ بِاللَّـهِ وَرَسُولِهِ وَتُجَاهِدُونَ فِي سَبِيلِ اللَّـهِ بِأَمْوَالِكُمْ وَأَنفُسِكُمْ ۚ ذَٰلِكُمْ خَيْرٌ لَّكُمْ إِن كُنتُمْ تَعْلَمُونَ
يَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَيُدْخِلْكُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِن تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ وَمَسَاكِنَ طَيِّبَةً فِي جَنَّاتِ عَدْنٍ ۚ ذَٰلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ
وَأُخْرَىٰ تُحِبُّونَهَا ۖ نَصْرٌ مِّنَ اللَّـهِ وَفَتْحٌ قَرِيبٌ ۗ وَبَشِّرِ الْمُؤْمِنِينَ

অর্থঃ হে ঈমানদারগণ! আমি কি তোমাদিগকে এমন ব্যবসার কথা বলিব যাহা তোমাদিগকে যন্ত্রনাদায়ক আজাব হইতে রক্ষা করিবে? তোমরা ঈমান আন আল্লহর উপর, তাঁহার রসূলের উপর এবং জিহাদ কর আল্লহর পথে আপন জান ও মাল দ্বারা। ইহা তোমাদের জন্য খুবই উত্তম যদি তোমরা বুঝিতে পার। আল্লহ তায়া’লা তোমাদের গুনাহ সমূহ মাফ করিয়া দিবেন এবং তোমাদিগকে এমন বাগানসমূহে প্রবেশ করাইবেন যাহার নিচে নহরসমূহ জারি থাকিবে। আর উত্তম বাসস্থানসমূহে যাহা চিরস্থায়ী বাগানসমূহের মধ্যে থাকিবে। ইহা বিরাট সাফল্য। আরও একটি জিনিস রহিয়াছে যাহা তোমরা পছন্দ কর–উহা হইল আল্লহ তায়া’লার পক্ষ থেকে সাহায্য ও আসন্ন বিজয়। আর আপনি (হে নবী!) মুমিনদিগকে সুসংবাদ দিয়া দিন। (সূরা সফ্‌, ১০-১৩)

এই আয়াতে একটি ব্যবসার কথা উল্লেখ করা হইয়াছে। যাহার প্রথম লাভ হইল যন্ত্রনাদায়ক আযাব হইতে নাযাত দানকারী। এই ব্যবসা এই যে, আমরা আল্লহ তায়া’লা ও তাঁহার রসূলের উপর ঈমান আনি এবং আল্লহর রাস্তায় আপন জান-মাল দিয়া জিহাদ করি। ইহা এমন কাজ যাহা নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য মঙ্গলজনক; যদি আমাদের মধ্যে সামান্যতম বুদ্ধি বিবেচনাও থাকিয়া থাকে। এই মামুলী কাজের বিনিময়ে আমরা কি পরিমাণ লাভজনক হইব–আমাদের সমস্ত গুনাহ ও ভুল-ত্রুটি একেবারে মাফ করিয়া দেওয়া হইবে এবং আখেরাতে বড় বড় নিয়ামাত দ্বারা পুরষ্কৃত করা হইবে। এতটুকু হইলেও ইহা অনেক বড় কামিয়াবী ও মর্যাদার বিষয়। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। বরং আমাদের আখাংকিত বস্তুও আমাদের দেওয়া হইবে। আর তাহা হইল দুনিয়ার উন্নতি, সাহায্য ও সফলতা এবং শত্রুর উপর বিজয় ও রাজত্ব।

আল্লহ তায়া’লা আমাদের নিকট দুইটি জিনিস চাহিয়াছেন। প্রথমটি হইল, আমরা আল্লহ ও তাঁহার রসূলের ঈমান আনি। আর দ্বিতীয়টি হইল আমরা জান মাল দ্বারা আল্লহর রাস্তায় জিহাদ করি। ইহার বিনিময়ে আল্লহ তায়া’লা আমাদিগকে দুইটি জিনিসের নিশ্চয়তা দিয়াছেন। আখেরাতে জান্নাত ও চিরস্থায়ী সুখ-শান্তি। আর দুনিয়াতে সাহায্য ও কামিয়াবী। প্রথম যে জিনিসটি আমাদের নিকট চাওয়া হইতেছে উহা হইল ঈমান। আর একথা স্পষ্ট যে, আমাদের এই চেষ্টা মেহনতের আসল উদ্দেশ্যও ইহাই যে, প্রকৃত ঈমানের দৌলত আমাদের নসীব হইয়া যায়। দ্বিতীয় যে জিনিস আমাদের নিকট চাওয়া হইতেছে উহা হইল জিহাদ। জিহাদের আসল উদ্দেশ্য যদিও কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও মুকাবিলা করা তথাপি জিহাদের মূল লক্ষ্য হইল আল্লহ তায়া’লার কালেমা বুলন্দ করা ও তাঁহার হুকুম-আহকাম পূর্ণভাবে চালু করা। আর ইহাই আমাদের কাজের মূল উদ্দেশ্য।

অতএব বুঝা গেল যে, মৃত্যুর পরবর্তী জীবন সুন্দর ও সুখময় হওয়া এবং জান্নাতের নিয়ামাতসমূহ লাভ করা যেমন আল্লহ তায়া’লা ও তাঁহার রসূলের প্রতি ঈমান আনা ও দ্বীনের রাস্তায় চেষ্টা-মেহনত করার উপর নির্ভরশীল, তেমনি দুনিয়ার জীবনে সুখ-শান্তি লাভ করা ও দুনিয়ার নিয়ামাতসমূহ দ্বারা ফায়দা হাসিল করাও ইহার উপর নির্ভরশীল যে, আমরা আল্লহ তায়া’লা ও রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের উপর ঈমান আনি এবং আমাদের সমস্ত চেষ্টা-মেহনতকে আল্লহর রাস্তায় খরচ করি।

আর যখন আমরা এই কাজকে সঠিকভাবে আঞ্জাম দিব অর্থাৎআল্লহ তায়া’লা ও রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের উপর ঈমান আনিব এবং আল্লহর রাস্তায় চেষ্টা ও মেহনত করিয়া নিজেদেরকে নেক আমাল দ্বারা গড়িয়া তুলিব তখন আমরা সারা দুনিয়ার বাদশাহী ও খিলাফাতে উপযোগী হইতে পারিব এবং আমাদের সালতানাত ও হুকুমত দেয়া হইবে–

وَعَدَ اللَّـهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنكُمْ وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَيَسْتَخْلِفَنَّهُمْ فِي الْأَرْضِ كَمَا اسْتَخْلَفَ الَّذِينَ مِن قَبْلِهِمْ وَلَيُمَكِّنَنَّ لَهُمْ دِينَهُمُ الَّذِي ارْتَضَىٰ لَهُمْ وَلَيُبَدِّلَنَّهُم مِّن بَعْدِ خَوْفِهِمْ أَمْنًا ۚ يَعْبُدُونَنِي لَا يُشْرِكُونَ بِي شَيْئًا ۚ وَمَن كَفَرَ بَعْدَ ذَٰلِكَ فَأُولَـٰئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ

অর্থঃ তোমাদের মধ্যে যাহারা ঈমান আনিবে এবং নেক আমাল করিবে, তাহাদের সহিত আল্লহ তায়া’লা ওয়াদা করিয়াছেন, তাহাদিগকে জমিনের হুকুমত দান করিবেন, যেমন তিনি তাহাদের পূর্ববর্তীদের হুকুমত দান করিয়াছেন। যে দ্বীনকে তিনি তাহাদের জন্য পছন্দ করিয়াছেন উহাকে তাহাদের জন্য মজবুত করিয়া দিবেন এবং তাহাদের ভয়-ভীতি কে আমানের দ্বারা পরিবর্তন করিয়া দিবেন। তবে শর্ত এই যে, আমার ইবাদাত করিতে থাকিবে এবং কাহাকেও আমার সহিত শরীক করিবে না। (সূরা নূরঃ ৫৫)

এই আয়াতে পুরা উম্মতের সহিত ঈমান ও নেক আমালের উপর হুকুমত দান করার ওয়াদা করা হইয়াছে। যাহার বাস্তব প্রকাশ নবী করীম সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের যামানা হইতে শুরু করিয়া খুলাফায়ে রাশেদীনের যামানা পর্যন্ত একাধারে ঘটিয়াছে। যেমন সমগ্র আরব উপদ্বীপ রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের যামানায় এবং পার্শ্ববর্তী দেশ সমূহ খুলাফায়ে রাশেদীনের যামানায় ইসলামের পতাকা তলে চলিয়া আসে। পরবর্তী যামানায় একাধারে না হইলেও বিভিন্ন সময়ে নেককার বাদশাহ ও খলীফাগণের বেলায় এই ওয়াদার বাস্তবায়ন ঘটিতে থাকে এবং ভবিষ্যতেও ঘটিতে থাকিবে। যেমন এক আয়াতে বলা হইয়াছে–

َإِنَّ حِزْبَ اللَّـهِ هُمُ الْغَالِبُونَ

অর্থঃ নিশ্চয়ই আল্লহর দলই বিজয়ী হইবে। (সূরা মায়েদাহঃ ৫৬)

সুতরাং জানা গেল যে, এই দুনিয়াতে সুখ-শান্তি, নিরাপত্তা, আরাম-আয়েশ ও ইজ্জাত-সম্মানের সহিত জীবন যাপন করিতে হইলে ইহা ছাড়া আর কোন উপায় নাই যে, আমরা এই তরীকায় মজবুতির সহিত কাজ করিতে থাকি এবং আমাদের ইনফারাদী (ব্যক্তিগত) ও ইজতেমায়ী (সমষ্টিগত) সর্বপ্রকার শক্তি এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য ওয়াকফ করিয়া দিই–

وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّـهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا ۚ

অর্থাৎঃ তোমরা সকলেই দ্বীনকে মজবুত ভাবে আকড়াইয়া ধর; পরস্পর খন্ড-বিখন্ড হইও না। (সূরা আল-ইমরানঃ ১০৩)

ফাযায়েলে আমাল (দারুল কিতাব, অক্টোবর ২০০১) পৃষ্ঠা ১০১১-১০১৫

রোগ নিরাময়ের জন্য এক কর্ম পদ্ধতি

এখন যেহেতু জীবনের মাকসাদ স্পষ্ট হইয়া গেল এবং আসল রোগ ও উহার চিকিৎসার তরীকা জানা হইয়া গেল, কাজেই রোগ নিরাময়ের ব্যবস্থা করিতে এখন আর কোন অসুবিধা হবে না এবং এই লক্ষ্যে চিকিৎসার যে কোন তরীকাই গ্রহণ করা হইবে–ইনশাআল্লহ উপকারী ও ফলদায়ক হইবে।

আমরা আমাদের দুর্বল জ্ঞানবুদ্ধি অনুযায়ী মুসলমানদের কামিয়াবী ও উন্নতির লক্ষ্যে একটি কর্ম পদ্ধতি ঠিক করিয়াছি, প্রকৃতপক্ষে যাহাকে ইসলামী জিন্দেগী অথবা আমাদের পূর্ববর্তী বুযুর্গদের জিন্দেগীর নমুনা বলা যাইতে পারে। যাহার সংক্ষিপ্ত নকশা আপনাদের সম্মুখে পেশ করা হইল।

সর্বপ্রথম ও সবচাইতে গুরুত্বপুর্ণ বিষয় হইল, প্রতিটি মুসলমান সর্বপ্রকার দুনিয়াবী স্বার্থ ও উদ্দেশ্য হইতে মুক্ত হইয়া আল্লহ তায়া’লা কালেমা বুলন্দ করা ও দ্বীনের প্রচার প্রসার ও খোদায়ী হুকুম আহকামের প্রচলন ও উহাকে শক্তিশালী করাকে জীবনের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বানাইয়া লইবে এবং এই কথার উপর দৃঢ় ওয়াদা করিবে যে, আমি আল্লহ তায়া’লার প্রতিটি হুকুম মান্য করিব এবং সেই অনুযায়ী আমাল করিবার চেষ্টা করিব। কখনই আল্লহ তায়া’লার নাফরমানী করিব না। অতঃপর এই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পূর্ণ করার জন্য নিম্নবর্ণিত মূলনীতিগুলির উপর আমাল করিবেঃ

(১) কালেমা লা-ইলাহা ইল্লাল্লহু মুহা’ম্মাদুর রসুলুল্লহ সঠিক উচ্চারণের সহিত মুখস্থ করা। উহার অর্থ ও উদ্দেশ্যকে বুঝা ও অন্তরে গাঁথিয়া নেওয়ার চেষ্টা করা এবং নিজের পুরা জীবনকে তদনুযায়ী গড়িয়া তোলার ফিকির করা।

(২) নামাযের পাবন্দী করা এবং নামাযের আদাব ও শর্তসমূহের প্রতি খেয়াল রাখিয়া খুশু খুযুর সহিত নামায আদায় করা। নামাযের প্রতিটি রোকন আদায়ের সময় আল্লহ তায়া’লার বড়ত্ব ও মহত্ত্ব এবং নিজের দাসত্ব ও অক্ষমতার ধ্যান করা। মোট কথা সর্বদা এই চেষ্টায় লাগিয়া থাকা যেন নামায এমন ভাবে আদায় হয়–যাহা আল্লহ তায়া’লা রব্বুল ইজ্জাতের দরবারে পেশ হওয়ার উপযুক্ত হয়। এইরূপ নামাযের চেষ্টা করিতে থাকিবে এবং আল্লহ তায়া’লার দরবারে তাওফীক চাহিবে। যদি নামাযের নিয়ম জানা না থাকে তবে উহা শিখিবে এবং নামাযে যাহা কিছু পড়া হয় উহা মুখস্থ করিবে।

(৩) কুরআনে কারীমের সাথে ঘনিষ্ট সম্পর্ক ও আন্তরিক মুহাব্বাত পয়দা করিতে হইবে, যাহার দুইটি তরীকা রহিয়াছেঃ

(ক) রোজানা কিছু সময় আদাব ও এহতেরামের সহিত অর্থের প্রতি ধ্যান করিয়া তেলাওয়াত করা। আলীম না হইলে এবং অর্থ বুঝিতে না পারিলে অর্থ বুঝা ছাড়াই তেলাওয়াত করিবে এবং মনে করিবে যে আমার কামিয়াবী ও উন্নতি ইহার মধ্যেই নিহিত রহিয়াছে। শুধু শব্দ তেলাওয়াত করাও বড় সৌভাগ্য ও খায়ের বরকতের কারণ। আর শব্দও যদি তেলাওয়াত করিতে না পারে তবে রোজানা কিছু সময় কুরআন শিক্ষার কাজে ব্যয় করা।

(খ) নিজের আওলাদ এবং মহল্লা ও এলাকার ছেলেমেয়েদের কুরআন ও ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়ার ফিকির করা এবং সকল ক্ষেত্রে ইহাকে প্রাধান্য দেওয়া।

(৪) কিছু সময় আল্লহ তায়া’লার স্মরণ ও যিকিরে-ফিকিরে অতিবাহিত করা। ওজীফা হিসাবে কিছু পাঠ করার জন্য সুন্নতের অনুসারী তরীকতের কোন শায়েখের নিকট হইতে জানিয়া লইবে। তা না হইলে সুওম কালেমা অর্থাৎ সুবহানাল্লহি ওয়াল-হা’মদুলিল্লাহি ওয়া লা-ইলাহা ইল্লাল্লহু আল্লহু আকবার, ওয়া লা-হা’ওলা ওয়া লা-কুয়্যাতা ইল্লাবিল্লাহিল আলিয়্যিল আযীম, দুরুদ শরীফ ও এস্তগফার পড়িবে। অর্থের প্রতি খেয়াল রাখিয়া ও দিল লাগাইয়া প্রত্যেকটি রোজানা সকাল-সন্ধ্যা এক তাসবীহ (১০০ বার) করিয়া পাঠ করিবে। হাদীস শরীফে এই তাসবীহ পাঠের বিরাট ফযীলত আসিয়াছে।

(৫) প্রত্যেক মুসলমানকে নিজের ভাই মনে করা। তাহার সহিত সমবেদনা ও সহানুভূতির আচরণ করা। মুসলমান হওয়ার কারণে তাহার আদাব ও সম্মান করা। কোন মুসলমানের কষ্ট হইতে পারে এমন কথা বার্তা ও কাজ হইতে বিরত থাকা।

উপরোক্ত বিষয়সমূহ নিজে পাবন্দী সহকারে পালন করিবে এবং প্রত্যেক মুসলমান ভাইও যেন উহা পালন করিতে পারে সেইজন্য চেষ্টা করিবে। আর ইহার পন্থা হইল এই যে, দ্বীনের খেদমতের জন্য নিজেও কিছু সময় ফারেগ করিবে অন্যদেরকেও তারগীব দিয়া দ্বীনের খেদমত ও ইসলামের প্রচার-প্রসারের জন্য তৈয়ার করিবে।

যে দ্বীনের প্রচার-প্রসারের জন্য আম্বিয়া কেরাম আ’লাইহিমুস সালাম দুঃখ কষ্ট সহ্য করিয়াছেন, বিভিন্ন রকম মুসীবাতের সম্মুখীন হইয়াছেন, সাহাবাহ কেরাম রদিয়াল্লহু আ’নহুম ও আমাদের বুযুর্গগণ এই কাজে নিজেদের জীবন ব্যয় করিয়াছেন এবং উহার জন্য আল্লহ তায়া’লা রাস্তায় নিজেরদের জান কুরবান করিয়াছেন, সেই দ্বীনের প্রচার ও হিফাযতের জন্য কিছু সময় বাহির না করা বড় দুর্ভাগ্য ও ক্ষতির কারণ। আর ইহাই সেই মহান দায়িত্ব যাহা ছাড়িয়া দেওয়ার কারণে আমরা আজ আমরা ধ্বংস ও বরবাদ হইতেছি।

আগেকার দিনে মুসলমান হওয়ার অর্থ ইহাই বুঝা হইত যে, নিজের জান-মাল, ইজ্জাত-আব্রু দ্বীনের প্রচার ও আল্লহ তায়া’লার কালেমাকে বুলন্দ করার জন্য কুরবান করিতে হইবে আর যে ব্যক্তি এই কাজে গাফলতি করিত তাকে বড় নাদান মনে করা হইত। কিন্তু আফসোস যে, আজ আমরা মুসলমান হিসাবে পরিচিত এবং চোখের সামনে দ্বীনের কাজ মিটিতেছে দেখিতেছি, তবুও সেই দ্বীনের প্রচার-প্রসার ও হিফাযতের জন্য চেষ্টা হইতে দূরে সরিয়া থাকি। মোটকথা, আল্লহ তায়া’লার কালেমাকে বুলন্দ করা ও দ্বীনের প্রচার-প্রসার করা যাহা মুসলমানের জীবনের মূল লক্ষ্য ও আসল কাজ ছিল এবং যাহার সহিত উভয় জাহানের কামিয়াবী ও উন্নতি জড়িত ছিল এবং যাহা ছাড়িয়া দিয়া আজ আমরা লাঞ্চিত ও বেইজ্জত হইতেছি; এখন পুনরায় আমাদের মূল উদ্দেশ্যকে গ্রহণ করা উচিত এবং ঐ কাজকে আমাদের জীবনের অঙ্গ ও আসল কাজ বানানো উচিত। যাহাতে আল্লহ তায়া’লার রহমত পুনরায় জোশে আসিয়া যায় এবং দুনিয়া ও আখেরাতের সম্মান ও সুখ নসীব হয়। ইহার অর্থ কখনও এই নহে যে, নিজের সমস্ত কাজ-কর্ম বাদ দিয়া শুধু এই কাজেই লাগিয়া যাইবে। বরং উদ্দেশ্য হইল দুনিয়ার অন্যান্য জরুরত যেমন মানুষের লাগিয়াই থাকে এবং সেইগুলিকে পুরা করা হয়, তেমনি এই কাজকেও জরুরী ও গুরুত্বপূর্ণ মনে করিয়া ইহার জন্য সময় বাহির করা হয়। কিছু লোক যখন এই কাজের জন্য তৈয়ার হইয়া যাইবে তখন সপ্তাহে কয়েক ঘন্টা নিজ মহল্লায়, মাসে তিন দিন আশপাশ এলাকায়, বছরে এক চিল্লা দূরবর্তী এলাকায় এই কাজ করিবে এবং চেষ্টা করিবে–ধনী হউক বা গরীব, ব্যবসায়ী হউক বা চাকুরীজীবী, জমিদার হউক বা কৃষক, আলীম হউক বা গায়ের-আলীম প্রত্যেক মুসলমান যেন এই কাজে শরিক হইয়া যায় এবং উপরোক্ত বিষয়গুলি পালন করিয়া চলে।

ফাযায়েলে আমাল (দারুল কিতাব, অক্টোবর ২০০১) পৃষ্ঠা ১০০৬-১০০৯