হিজরী ৬ষ্ঠ সনে যিলকদ মাসে হুদাইবিয়ার প্রসিদ্ধ যুদ্ধ সংঘটিত হয় যখন রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম উমরা পালনের উদ্দেশ্যে সাহাবাহ কেরাম রদিয়াল্লহু আ’নহুম দের এক বিরাট জামাত লইয়া রওয়ানা হইয়াছিলেন। মক্কার কাফেরদের নিকট যখন এই সংবাদ পৌঁছিল তখন তাহারা নিজেদের মধ্যে পরমর্শ করিয়া এই সিদ্ধান্ত করিল যে, মুসলমানদের মক্কার প্রবেশে বাধা দিতে হইবে। এই জন্য তাহারা বিরাট আকারে প্রস্তুতি গ্রহণ করিল এবং মক্কার বাহিরের লোকদিগকেও তাহাদের সহিত শরীক হওয়ার জন্য দাওয়াত দিল এবং বিরাট দল লইয়া মুকাবেলার জন্য প্রস্তুত হইল। যুল হুলাইফা নামক স্থান হইতে এক ব্যক্তিকে রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম খবর লওয়র জন্য পাঠাইলেন যিনি মক্কা হইতে বিস্তারিত অবস্থা জানিয়া উসফান নামক স্থানে রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের সহিত সাক্ষাত করিলেন। তিনি বলিলেন যে, মক্কাবাসীরা বিরাট আকারে মুকাবিলার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করিয়াছে এবং তাহাদের সাহায্যের জন্য বাহির হইতেও বহু লোক সংগ্রহ করিয়া রাখিয়াছে। রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবাহ কেরাম রদিয়াল্লহু আ’নহুমদের সহিত পরমর্শ করিলেন যে, এই পরিস্থিতিতে কি করা উচিত। এক পন্থা হইতে পারে, যে সমস্ত লোক বাহির হইতে সাহায্য করার জন্য গিয়াছে তাহাদের ঘরবাড়ির উপর হামলা করা, যখন তাহারা এই সংবাদ পাইবে মক্কা হইতে ফিরিয়া আসিবে। অন্যপন্থা হইল সোজা সামনের দিকে চলা। হযরত আবু বকর সিদ্দীক রদিয়াল্লহু আ’নহু বলিলেন, ইয়া রসুলুল্লহ! এই মুহুর্তে আপনি বাইতুল্লহর উদ্দেশ্যে আসিয়াছেন যুদ্ধ করার উদ্দেশ্য তো ছিলই না। তাই সামনের দিকে অগ্রসর হউন। তাহারা যদি আমাদিগকে বাধা দেয় তবে মুকাবিলা করিব, নতুবা নহে। রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম এই পরমর্শ গ্রহণ করিলেন এবং সামনের দিকে অগ্রসর হইলেন।
হুদাইবিয়া নামক জায়গায় পৌঁছিলে বুদাইল ইবনে ওরাকা খুযায়ী একদল লোকসহ আসিল এবং রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট জানাইল যে, কাফেররা কিছুতেই রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম কে মক্কায় প্রবেশ করিতে দিবে না। তাহারা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হইয়া আছে। রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলিলেন যে, আমরা যুদ্ধ করিতে আসি নাই। আমাদের উদ্দেশ্য কেবল উমরা করা। তাছাড়া দৈনন্দিন যুদ্ধ-বিগ্রহ কুরাইশদের বহু ক্ষতিগ্রস্থ করিয়াছে, সম্পূর্ণ ধ্বংস করিয়া দিয়াছে। তাহারা সম্মত হইলে আমি তাহাদের সহিত সন্ধি করিতে প্রস্তুত আছি। আমাদের ও তাহাদের মধ্যে এই বিষয়ে চুক্তি হইয়া যাক যে, তাহারা আমাদের পিছনে পড়িবে না আমিও তাহাদের পিছনে পড়িব না এবং আমাদের অন্যের সহিত বুঝাপড়া করিবার সু্যোগ দিক। আর যদি তাহারা কিছুতেই রাজী না হয়, তবে ঐ যাতের কসম যাহার হাতে আমার প্রাণ, আমি ততক্ষন পর্যন্ত তাহাদের সহিত যুদ্ধ করিব যতক্ষন পর্যন্ত ইসলাম বিজয়ী না হইবে অথবা আমার গর্দান বিছিন্ন না হইবে। বুদাইল বলিল আচ্ছা আমি আপনার এই পয়গাম তাহাদের নিকট পৌঁছাইয়া দিতেছি। সে ফিরিয়া গেল এবং যাইয়া পয়গাম পৌঁছাইল। কিন্তু কাফেররা রাজী হইল না। এমনিভাবে উভয় পক্ষ হইতে আসা যাওয়া চলিতে থাকিল। তন্মধ্যে একবার ওরওয়া ইবনে মাসঊ’দ সাকাফী কাফেরদের পক্ষ হইতে আসিলেন। তিনি তখনও মুসলমান হইয়াছিলেন না, পরে হইয়াছেন। রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম তাহার সহিতও একই আলোচনা করিলেন যাহা বুদাইলের সহিত করিয়াছিলেন। ওরওয়া বলিলেন, মুহা’ম্মাদ, (সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) আপনি যদি আরবদিগকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করিয়া দিতে চান তবে ইহা সম্ভব নহে। আপনি কি কখনও শুনিয়াছেন যে, আপনার পূর্বে এমন কোন ব্যক্তি অতীত হইয়াছে যে কিনা আরবদিগকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করিয়া দিয়াছে? আর যদি বিপরীত অবস্থা হয়, অর্থাৎ তাহারা যদি আপনার উপর বিজয়ী হয় তবে মনে রাখুন, আমি আপনার সহিত ভদ্র শ্রেণীর লোকজন দেখিতেছি না। এদিক সেদিকের নিম্নশ্রেণীর লোকজন আপনার সহিত আছে। বিপদের সময় সকলেই পালাইয়া যাইবে। হযরত আবু বকর রদিয়াল্লহু আ’নহু পাশে দাঁড়ানো ছিলেন। তিনি এই বাক্য শুনিয়া ক্রোধান্বিত হইলেন এবং বলিলেন, তুই গিয়া তোর মাবুদ লাতের লজ্জাস্থান চাট। আমরা কি রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট হইতে পালাইয়া যাইব? এবং তাঁহাকে একা ছাড়িয়া দিব? ওরওয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, এই ব্যক্তি কে? রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম ব্ললিনে, আবু বকর। তিনি আবু বকর রদিয়াল্লহু আ’নহু কে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, তোমার অতীত একটি অনুগ্রহ আমার উপর রহিয়াছে যাহার প্রতিদান আমি তোমাকে দিতে পারি নাই। যদি ইহা না হইত তবে তোমার এই গালির জবাব দিতাম। এই বলিয়া ওরওয়া পুনরায় রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের সহিত কথাবার্তায় মশগুল হইয়া গেলেন এবং আরবদের সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী কথাবার্তার সময় রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের দাড়ি মুবারকের দিকে হাত বাড়াইতেন। কেননা খোশামোদ করার সময় দাড়িতে হাত বুলাইয়া কথা বলা হইয়া থাকে। কিন্তু সাহাবাহ কেরাম রদিয়াল্লহু আ’নহুম ইহা কিভাবে সহ্য করিতে পারেন! ওরওয়ার ভাতিজা মুগীরা ইবনে শু’বা রদিয়াল্লহু আ’নহু মাথায় লৌহ শিরস্ত্রাণ করিয়া অস্ত্রসজ্জিত অবস্থায় পাশে দন্ডায়মান ছিলেন। তিনি তরবারীর বাট দ্বারা ওরওয়ার হাতে আঘাত করিয়া বুলিলেন, হাত দূরে রাখ। ওরওয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, এই লোকটি কে? রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলিলেন, মুগীরা। ওরওয়া বলিলেন, হে গাদ্দার! তোর গাদ্দারীর ফল আমি এখন পর্যন্ত ভুগিতেছি আর তোর এই ব্যবহার? (হযরত মুগীরা ইবনে শু’বা রদিয়াল্লহু আ’নহু ইসলাম গ্রহণের পূর্বে কয়েকজন কাফেরকে হত্যা করিয়া ছিলেন। উহার রক্তপণ ওরওয়া আদায় করিয়া ছিলেন। তিনি ঐ দিকে ইঙ্গিত করিলেন।) মোটকথা দীর্ঘ সময় রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের সহিত কথাবার্তা বলিতে থাকিলেন এবং সকলের দৃষ্টির অগোচরে সাহাবাহ কেরাম রদিয়াল্লহু আ’নহুমদের অবস্থাও পর্যবেক্ষন করিতে থাকিলেন।
অতঃপর ফিরিয়া গিয়া কাফেরদের নিকট বলিলেন, হে কুরইশ! আমি বড় বড় রাজা বাদশার দরবারে গিয়াছি। কিসরা, কাইসার ও নাজ্জাশীর দরবারেও গিয়াছি। তাহাদের রীতিনীতি দেখিয়াছি। আল্লহর কসম! আমি কোন বাদশাকে দেখি নাই যে, তাহার লোকেরা তাহার এইরূপ সম্মান করে, যেইরূপ সম্মান মুহা’ম্মাদ (সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর লোকেরা তাঁহার সম্মান করে। যদি তিনি থুথু ফেলেন যাহার হাতে পড়িয়া যায়, সে উহা শরীরে ও চেহারায় মাখিয়া লয়। যে কথা মুহা’ম্মাদ (সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর মুখ হইতে বাহির হয় উহা পালন করার জন্য সকলেই ঝাঁপাইয়া পড়ে। তাঁহার অযুর পানি পরস্পর কাড়াকাড়ি করিয়া বন্টন করিয়া লয়, মাটিতে পড়িতে দেয় না। যদি কেহ পানির ফোঁটা না পায় তবে অন্যের ভিজা হাতে হাত মলিয়া নিজের মুখে মাখিয়া লয়। তাঁহার সামনে অত্যন্ত নিচু আওয়াজে কথা বলে, উচ্চ আওয়াজে কথা বলে না। আদবের কারণে তাঁহার দিকে চক্ষু উঠাইয়া দেখে না। যদি তাঁহার কোন দাঁড়ি বা চুল ঝরিয়া পড়ে তবে বরকতের জন্য উহা উঠাইয়া লয় এবং সম্মান করে। মোটকথা আমি কোন দলকেই আপন মনিবের সহিত এত মুহাব্বাত করিতে দেখি নাই, যত মুহাব্বাত মুহা’ম্মাদ (সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর লোকজন তাঁহার করিয়া থাকে।
এই অবস্থা চলাকালে মুহা’ম্মাদ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত উ’সমান রদিয়াল্লহু আ’নহু কে নিজের পক্ষ হইতে দূত হিসাবে মক্কার সরদারদের নিকট পাঠাইলেন। হযরত উ’সমান রদিয়াল্লহু আ’নহু মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও মক্কায় তাঁহার যথেষ্ট সম্মান ছিল এবং তাঁহার ব্যাপারে তেমন আশংকা ছিল না। এই কারণে রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁহাকে নির্বাচন করিয়াছিলেন। তিনি মক্কা গেলেন। সাহাবীদের (রদিয়াল্লহু আ’নহুম) ঈর্ষা হইল যে, উ’সমান তো আনন্দের সহিত কা’বাঘর তাওয়াফ করিতেছে। রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলিলেন, আমি আশা করি না যে, সে আমাকে ছাড়া তাওয়াফ করিবে। সুতরাং হযরত উ’সমান রদিয়াল্লহু আ’নহু যখন মক্কায় পৌঁছিলেন তখন আবান ইবনে সাঈ’দ তাঁহাকে নিরাপত্তা দিল এবং বলিল যে, যেখানে ইচ্ছা চলাফেরা করিতে পার, তোমাকে কেহ বাধা দিতে পারিবে না। হযরত উ’সমান রদিয়াল্লহু আ’নহু আবু সুফিয়ান ও মক্কার অন্যান্য সরদারদের সহিত সাক্ষাত করিতে থাকিলেন এবং রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের পয়গাম পৌঁছাইতে থাকিলেন। যখন ফিরিয়া আসিতে লাগিলেন তখন কাফিররা নিজেরাই অনুরোধ করিল যে, তুমি মক্কায় আসিয়াছ সুতরাং তাওয়াফ করিয়া যাও। তিনি জবাব দিলেন যে, ইহা আমার দ্বারা সম্ভব নয় যে, রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম কে বাধা দেওয়া হইয়াছে আর আমি তাওয়াফ করিব। কুরইশরা এই উত্তর শুনিয়া ক্ষিপ্ত হইয়া উ’সমান রদিয়াল্লহু আ’নহু কে আটক করিয়া রাখিল। মুসলমানদের নিকট এই সংবাদ পৌঁছিল যে, উ’সমান রদিয়াল্লহু আ’নহু কে শহীদ করিয়া দেওয়া হইয়াছে। ইহার উপর রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবাহ কেরাম রদিয়াল্লহু আ’নহুম দের নিকট হইতে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত লড়াই করিয়া যাওয়ার বাইয়াত গ্রহণ করিলেন। কাফেররা এই সংবাদ শুনিয়া ঘাবড়াইয়া গেল এবং উ’সমান রদিয়াল্লহু আ’নহু কে সঙ্গে সঙ্গে ছাড়িয়া দিল। (খামীস)
ফায়দাঃ এই ঘটনায় হযরত আবু বকর রদিয়াল্লহু আ’নহু এর উক্তি, হযরত মুগীরা রদিয়াল্লহু আ’নহু কতৃক আঘাত করা, সামগ্রিক ভাবে সাহাবাহ কেরাম রদিয়াল্লহু আ’নহুম দের আচরণ যাহা ওরওয়া গভীর ভাবে লক্ষ্য করিয়াছে, হযরত উ’সমান রদিয়াল্লহু আ’নহু কতৃক তাওয়াফ করিতে অস্বীকার করা–প্রত্যেকটি বিষয় রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি সাহাবাহ কেরাম রদিয়াল্লহু আ’নহুদের অকৃত্রিম ও পরম ভালবাসার পরিচয় দেয়। উল্লিখিত ঘটনায় যে বাইয়াতের কথা আলোচিত হইয়াছে উহাকে ‘বায়াতুশ-শাজারা’ বলা হয়। কুরআন পাকেও উহার উল্লেখ রহিয়াছে। আল্লহ তায়া’লা সূরা ফাতহের لَقَدْ رَضِيَ اللَّهُ عَنِ الْمُؤْمِنِينَ-الاية ইহা উল্লেখ করিয়াছেন। পূর্ণ আয়াত তরজমাসহ পরিশিষ্টে আসিবে।
ফাযায়েলে আমাল (দারুল কিতাব, অক্টোবর ২০০১) পৃষ্ঠা ৮৫৪-৮৫৮