Posts Tagged ‘তরবারী’

রোমের যুদ্ধে হযরত ইবনে যুবাইর রদিয়াল্লহু আ’নহুম এর বীরত্ব

হিজরী ২৬ সনে হযরত উ’সমান রদিয়াল্লহু আ’নহু এর খেলাফত আমলে মিশরের প্রথম গভর্নর হযরত আ’মর ইবনুল আ’স রদিয়াল্লহু আ’নহু এর স্থলে হযরত আ’ব্দুল্লহ ইবনে আবি সারাহ রদিয়াল্লহু আ’নহু শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। তিনি রোমকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য বিশ হাজারের একটি সৈন্যদল সহ বাহির হইলেন। রোমক সৈন্য সংখ্যা ছিল প্রায় দুই লক্ষ। প্রচন্ড যুদ্ধ হয়। রোমক সেনাপতি জারজীর ঘোষণা করিল যে, হযরত আ’ব্দুল্লহ ইবনে আবি সারাহ (রদিয়াল্লহু আ’নহু)কে যে ব্যক্তি হত্যা করিবে তাহার সহিত আমার কন্যা বিবাহ দিব এবং একলক্ষ দিনার পুরষ্কারও দিব। এই ঘোষণার কারণে মুসলমানদের মধ্যে কেহ কেহ চিন্তিত হইয়া পড়িলেন। হযরত আ’ব্দুল্লহ ইবনে যুবাইর রদিয়াল্লহু আ’নহুমা জানিতে পারিয়া বলিলেন, চিন্তার কারণ নাই। আমাদের পক্ষ হইতেও ঘোষণা দেওয়া হউক যে, যে ব্যক্তি জারজীরকে হত্যা করিবে তাহার সহিত জারজীরের কন্যা বিবাহ দেওয়া হইবে এবং একলক্ষ দীনার পুরষ্কারও দেওয়া হইবে। উপরন্তু তাহাকে ঐ সমস্ত শহরের আমীরও বানাইয়া দেওয়া হইবে।

মোটকথা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত লড়াই চলিতে থাকে। হযরত আ’ব্দুল্লহ ইবনে যুবাইর রদিয়াল্লহু আ’নহুমা দেখিলেন যে, জারজীর সৈন্যদলের পিছনে রহিয়াছে এবং সৈন্যরা তাহার সামনে রহিয়াছে। দুইজন বাঁদী তাহাকে ময়ুরের পাখা দ্বারা ছায়াদান করিতেছে। তিনি অতর্কিতে সৈন্যদলের মধ্যে হইতে সরিয়া একাকী যাইয়া তাহার উপরে হামলা করিলেন। সে ভাবিতেছিল যে, এই লোকটি একা আসিতেছে হয়ত কোন সন্ধির খবর লইয়া আসিতেছে। কিন্তু তিনি সোজা তাহার নিকটে পৌঁছিয়া তাহার উপর হামলা করিয়া দিলেন। এবং তরবারী দ্বারা শিরোচ্ছেদ করিয়া বর্শার মাথায় উঠাইয়া লইয়া আসিলেন। সবাই হতবাক হইয়া শুধু দেখিতেই রহিয়া গেল।

ফায়দাঃ হযরত আ’ব্দুল্লহ ইবনে যুবাইর রদিয়াল্লহু আ’নহুমা অল্প বয়স্কই ছিলেন। হিযরতের পর মুহাজিরদের মধ্যে প্রথম সন্তান তিনিই জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁহার জন্মগ্রহণে মুসলমানগণ অত্যন্ত আনন্দিত হইয়াছিলেন। কেননা, এক বৎসর যাবত কোন মুহাজিরের কোন পুত্র সন্তান জন্ম গ্রহণ করে নাই। তখন ইয়াহুদীরা বলিয়াছিল যে, আমরা মুহাজিরদের উপর যাদু করিয়াছি, তাহাদের পুত্র সন্তান জন্ম লাভ করিবে না। রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম সাধারণতঃ বাচ্চাদের বায়াত করিতেন না। কিন্তু হযরত আ’ব্দুল্লহ ইবনে যুবাইর রদিয়াল্লহু আ’নহুমা কে সাত বৎসর বয়সে বায়াত করিয়াছিলেন। উক্ত যুদ্ধের সময় তাঁহার বয়স ছিল চব্বিশ কি পঁচিশ বৎসর। এই বয়সে দুই লক্ষ সৈন্যের বাধাকে ডিঙ্গাইয়া এইভাবে সেনাপতির শির কাটিয়া আনা কোন সাধারণ ব্যাপার নহে।

ফাযায়েলে আমাল (দারুল কিতাব, অক্টোবর ২০০১) পৃষ্ঠা ৮৩৮-৮৩৯

রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তেকালে হযরত উ’মার রদিয়াল্লহু আ’নহু এর শোকাবেগ

হযরত উ’মার রদিয়াল্লহু আ’নহু এর অতুলনীয় শক্তি, সাহস, বীরত্ব ও বাহাদুরী যাহা আজ সাড়ে তেরশত বৎসর পরও বিশ্বব্যাপী প্রসিদ্ধ হইয়া আছে। আর ইসলামের প্রকাশ তাঁহার ইসলাম গ্রহণ করার কারণেই হইয়াছে। কেননা ইসলাম গ্রহণের পর স্বীয় ইসলামকে গোপন রাখা বরদাশত করেন নাই। রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের সহিত তাঁহার মুহাব্বাতের একটি ক্ষুদ্র দৃষ্টান্ত এই যে, এত বাহাদুরী সত্ত্বেও রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তেকালের অবস্থা সহ্য করতে পারেন নাই। অত্যন্ত অস্থির ও পেরেশান অবস্থায় খোলা তরবারী হাতে দাঁড়াইয়া গেলেন এবং বলিলেন, যে ব্যক্তি বলিবে রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম ইন্তেকাল করিয়া গিয়াছেন তাহার গর্দান উড়াইয়া দিব। রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম তো আপন রবের নিকট তাশরীফ নিয়া গেছেন যেমন হযরত মূসা আ’লাইহিস সালাম তূর পাহাড়ে তশরীফ লইয়া গিয়াছিলেন এবং শীঘ্রই রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম ফিরিয়া আসিবেন। এবং ঐ সমস্ত লোকদের হাত পা কাটিয়া দিবেন যাহারা তাঁহার ইন্তেকালের মিথ্যা খবর রটাইতেছে। হযরত উ’সমান রদিয়াল্লহু আ’নহু একেবারে নির্বাক ছিলেন দ্বিতীয় দিন পর্যন্ত কোন কথাই তাঁহার মুখ হইতে বাহির হয় নাই। চলাফেরা করিতেন কিন্তু কোন কথা বলিতেন না। হযরত আ’লী রদিয়াল্লহু আ’নহু নীরব ও নির্বাক বসিয়া ছিলেন। দেহে যেন স্পন্দনও ছিল না। একমাত্র হযরত আবু বকর রদিয়াল্লহু আ’নহু এর মধ্যেই দৃঢ়তা ছিল। তিনি সেই সময়ে পাহাড়তুল্য সমস্যার মুকাবিলা করিলেন নিজের সেই মুহাব্বাত সত্ত্বেও যাহা পূর্ববর্তী ঘটনায় বর্ণিত হইয়াছে। অত্যন্ত শান্তভাবে আসিয়া প্রথমে রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের কপাল মুবারকে চুম্বন করিলেন। অতঃপর বাহিরে আসিয়া উ’মার রদিয়াল্লহু আ’নহু কে বলিলেন, বসিয়া যাও। তারপর খুতবা পাঠ করিলেন, যাহার সারমর্ম এই ছিল, যে ব্যক্তি মুহা’ম্মাদ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের পুজা করে সে যেন জানিয়া রাখে যে, তাঁহার ইন্তেকাল হইয়া গিয়াছে। আর যে ব্যক্তি আল্লহ তায়া’লার ইবাদাত করে সে যেন জানিয়া রাখে যে, আল্লহ তায়া’লা জীবিত আছেন এবং চিরকাল থকিবেন। অতঃপর কালামে পাকের এই আয়াত وَمَا مُحَمَّدٌ إِلاَّ رَسُولٌ قَدْ خَلَتْ مِن قَبْلِهِ শেষ পর্যন্ত তেলাওয়াত করিলেন। (খামীস)

মুহা’ম্মাদ (সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) তো রসূল মাত্র (তিনি তো খোদা নহেন যে তাঁহার মৃত্যু আসিতে পারে না।) যদি তাঁহার ইন্তেকাল হইয়া যায় অথবা তিনি শহীদও হইয়া যান তবে কি তোমরা উল্টা দিকে ফিরিয়া যাইবে! আর যে ব্যক্তি উল্টা দিকে ফিরিয়া যাইবে যে আল্লহ তায়া’লার কোন ক্ষতি করিবে না। (নিজেরই ক্ষতি করিবে) আল্লহ তায়া’লা অতিসত্বর কৃতজ্ঞ বান্দাদিগকে প্রতিদান দিবেন। (সূরা আল ইমরনঃ ১৪৪) (বয়ানুল কুরআন)

ফায়দাঃ যেহেতু আল্লহ তায়া’লা হযরত আবু বকর সিদ্দীক রদিয়াল্লহু আ’নহু এর দ্বারা খিলাফাতের গুরুত্বপূর্ণ কাজ লইবেন তাই সেই সময়ে এই অবস্থাটিই তাঁহার উপযোগী ছিল। এই কারণেই সেই পরিস্থিতিতে হযরত আবু বকর সিদ্দীক রদিয়াল্লহু আ’নহু এর মধ্যে যতটুকু ধৈর্য্য ও দৃঢ়তা ছিল তাহা আর কাহারও মধ্যে ছিল না। সেই সঙ্গে মীরাস অর্থাৎ উত্তরাধিকার, দাফন ইত্যাদি বিষয়ে ঐ সময়ের উপযোগী মাসায়ালা যে পরিমাণ সিদ্দীকে আকবরের রদিয়াল্লহু আ’নহু জানা ছিল সামগ্রিক ভাবে আর কাহারও জানা ছিল না। যেমন রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের দাফন নিয়ে মতানৈক্য দেখা দিল যে, মক্কা মুকাররমায় দাফন করা হইবে নাকি মাদীনা মুনাওয়ারায়, নাকি বায়তুল মাকদাসে। তখন আবু বকর সিদ্দীক রদিয়াল্লহু আ’নহু বলিলেন, আমি রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম হইতে শুনিয়াছি নবীর কবর ঐ জায়গায়ই হয় যেখানে তাঁহার ইন্তেকাল হয়। অতএব যেখানে তাঁহার ইন্তেকাল হইয়াছে সেখানেই তাঁহার কবর খনন করা হউক। তিনি বলিলেন, আমি রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম হইতে শুনিয়াছি আমাদের (নবীগণের) কোন ওয়ারিস হয় না। আমরা যাহা কিছু রাখিয়া যাই তাহা সদকা স্বরূপ হইয়া থাকে।  তিনি বলিলেন, আমি রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম হইতে শুনিয়াছি যে, যে ব্যক্তি মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করে আর সে বেপরওয়াভাবে অবহেলা করিয়া অন্য কাহাকেও আমীর নিযুক্ত করে, তাহার উপরে লা’নত। রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম ইহাও বলিয়াছেন যে, কুরইশগণ এই বিষয়ের অর্থাৎ হুকুমাতের জিম্মাদার হইবে। ইত্যাদি, ইত্যাদি।

ফাযায়েলে আমাল (দারুল কিতাব, অক্টোবর ২০০১) পৃষ্ঠা ৮৫২-৮৫৩

হুদাইবিয়াতে হযরত আবু বকর সিদ্দিক ও হযরত মুগীরা রদিয়াল্লহু আ’নহুমা এর আচরণ ও সাধারণ সাহাবীদের কর্মধারা

হিজরী ৬ষ্ঠ সনে যিলকদ মাসে হুদাইবিয়ার প্রসিদ্ধ যুদ্ধ সংঘটিত হয় যখন রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম উমরা পালনের উদ্দেশ্যে সাহাবাহ কেরাম রদিয়াল্লহু আ’নহুম দের এক বিরাট জামাত লইয়া রওয়ানা হইয়াছিলেন। মক্কার কাফেরদের নিকট যখন এই সংবাদ পৌঁছিল তখন তাহারা নিজেদের মধ্যে পরমর্শ করিয়া এই সিদ্ধান্ত করিল যে, মুসলমানদের মক্কার প্রবেশে বাধা দিতে হইবে। এই জন্য তাহারা বিরাট আকারে প্রস্তুতি গ্রহণ করিল এবং মক্কার বাহিরের লোকদিগকেও তাহাদের সহিত শরীক হওয়ার জন্য দাওয়াত দিল এবং বিরাট দল লইয়া মুকাবেলার জন্য প্রস্তুত হইল। যুল হুলাইফা নামক স্থান হইতে এক ব্যক্তিকে রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম খবর লওয়র জন্য পাঠাইলেন যিনি মক্কা হইতে বিস্তারিত অবস্থা জানিয়া উসফান নামক স্থানে রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের সহিত সাক্ষাত করিলেন। তিনি বলিলেন যে, মক্কাবাসীরা বিরাট আকারে মুকাবিলার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করিয়াছে এবং তাহাদের সাহায্যের জন্য বাহির হইতেও বহু লোক সংগ্রহ করিয়া রাখিয়াছে। রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবাহ কেরাম রদিয়াল্লহু আ’নহুমদের সহিত পরমর্শ করিলেন যে, এই পরিস্থিতিতে কি করা উচিত। এক পন্থা হইতে পারে, যে সমস্ত লোক বাহির হইতে সাহায্য করার জন্য গিয়াছে তাহাদের ঘরবাড়ির উপর হামলা করা, যখন তাহারা এই সংবাদ পাইবে মক্কা হইতে ফিরিয়া আসিবে। অন্যপন্থা হইল সোজা সামনের দিকে চলা। হযরত আবু বকর সিদ্দীক রদিয়াল্লহু আ’নহু বলিলেন, ইয়া রসুলুল্লহ! এই মুহুর্তে আপনি বাইতুল্লহর উদ্দেশ্যে আসিয়াছেন যুদ্ধ করার উদ্দেশ্য তো ছিলই না। তাই সামনের দিকে অগ্রসর হউন। তাহারা যদি আমাদিগকে বাধা দেয় তবে মুকাবিলা করিব, নতুবা নহে। রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম এই পরমর্শ গ্রহণ করিলেন এবং সামনের দিকে অগ্রসর হইলেন।

হুদাইবিয়া নামক জায়গায় পৌঁছিলে বুদাইল ইবনে ওরাকা খুযায়ী একদল লোকসহ আসিল এবং রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট জানাইল যে, কাফেররা কিছুতেই রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম কে মক্কায় প্রবেশ করিতে দিবে না। তাহারা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হইয়া আছে। রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলিলেন যে, আমরা যুদ্ধ করিতে আসি নাই। আমাদের উদ্দেশ্য কেবল উমরা করা। তাছাড়া দৈনন্দিন যুদ্ধ-বিগ্রহ কুরাইশদের বহু ক্ষতিগ্রস্থ করিয়াছে, সম্পূর্ণ ধ্বংস করিয়া দিয়াছে। তাহারা সম্মত হইলে আমি তাহাদের সহিত সন্ধি করিতে প্রস্তুত আছি। আমাদের ও তাহাদের মধ্যে এই বিষয়ে চুক্তি হইয়া যাক যে, তাহারা আমাদের পিছনে পড়িবে না আমিও তাহাদের পিছনে পড়িব না এবং আমাদের অন্যের সহিত বুঝাপড়া করিবার সু্যোগ দিক। আর যদি তাহারা কিছুতেই রাজী না হয়, তবে ঐ যাতের কসম যাহার হাতে আমার প্রাণ, আমি ততক্ষন পর্যন্ত তাহাদের সহিত যুদ্ধ করিব যতক্ষন পর্যন্ত ইসলাম বিজয়ী না হইবে অথবা আমার গর্দান বিছিন্ন না হইবে। বুদাইল বলিল আচ্ছা আমি আপনার এই পয়গাম তাহাদের নিকট পৌঁছাইয়া দিতেছি। সে ফিরিয়া গেল এবং যাইয়া পয়গাম পৌঁছাইল। কিন্তু কাফেররা রাজী হইল না। এমনিভাবে উভয় পক্ষ হইতে আসা যাওয়া চলিতে থাকিল। তন্মধ্যে একবার ওরওয়া ইবনে মাসঊ’দ সাকাফী কাফেরদের পক্ষ হইতে আসিলেন। তিনি তখনও মুসলমান হইয়াছিলেন না, পরে হইয়াছেন। রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম তাহার সহিতও একই আলোচনা করিলেন যাহা বুদাইলের সহিত করিয়াছিলেন। ওরওয়া বলিলেন, মুহা’ম্মাদ, (সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) আপনি যদি আরবদিগকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করিয়া দিতে চান তবে ইহা সম্ভব নহে। আপনি কি কখনও শুনিয়াছেন যে, আপনার পূর্বে এমন কোন ব্যক্তি অতীত হইয়াছে যে কিনা আরবদিগকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করিয়া দিয়াছে? আর যদি বিপরীত অবস্থা হয়, অর্থাৎ তাহারা যদি আপনার উপর বিজয়ী হয় তবে মনে রাখুন, আমি আপনার সহিত ভদ্র শ্রেণীর লোকজন দেখিতেছি না। এদিক সেদিকের নিম্নশ্রেণীর লোকজন আপনার সহিত আছে। বিপদের সময় সকলেই পালাইয়া যাইবে। হযরত আবু বকর রদিয়াল্লহু আ’নহু পাশে দাঁড়ানো ছিলেন। তিনি এই বাক্য শুনিয়া ক্রোধান্বিত হইলেন এবং বলিলেন, তুই গিয়া তোর মাবুদ লাতের লজ্জাস্থান চাট। আমরা কি রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট হইতে পালাইয়া যাইব? এবং তাঁহাকে একা ছাড়িয়া দিব? ওরওয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, এই ব্যক্তি কে? রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম ব্ললিনে, আবু বকর। তিনি আবু বকর রদিয়াল্লহু আ’নহু কে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, তোমার অতীত একটি অনুগ্রহ আমার উপর রহিয়াছে যাহার প্রতিদান আমি তোমাকে দিতে পারি নাই। যদি ইহা না হইত তবে তোমার এই গালির জবাব দিতাম। এই বলিয়া ওরওয়া পুনরায় রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের সহিত কথাবার্তায় মশগুল হইয়া গেলেন এবং আরবদের সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী কথাবার্তার সময় রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের দাড়ি মুবারকের দিকে হাত বাড়াইতেন। কেননা খোশামোদ করার সময় দাড়িতে হাত বুলাইয়া কথা বলা হইয়া থাকে। কিন্তু সাহাবাহ কেরাম রদিয়াল্লহু আ’নহুম ইহা কিভাবে সহ্য করিতে পারেন! ওরওয়ার ভাতিজা মুগীরা ইবনে শু’বা রদিয়াল্লহু আ’নহু মাথায় লৌহ শিরস্ত্রাণ করিয়া অস্ত্রসজ্জিত অবস্থায় পাশে দন্ডায়মান ছিলেন। তিনি তরবারীর বাট দ্বারা ওরওয়ার হাতে আঘাত করিয়া বুলিলেন, হাত দূরে রাখ। ওরওয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, এই লোকটি কে? রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলিলেন, মুগীরাওরওয়া বলিলেন, হে গাদ্দার! তোর গাদ্দারীর ফল আমি এখন পর্যন্ত ভুগিতেছি আর তোর এই ব্যবহার? (হযরত মুগীরা ইবনে শু’বা রদিয়াল্লহু আ’নহু ইসলাম গ্রহণের পূর্বে কয়েকজন কাফেরকে হত্যা করিয়া ছিলেন। উহার রক্তপণ ওরওয়া আদায় করিয়া ছিলেন। তিনি ঐ দিকে ইঙ্গিত করিলেন।) মোটকথা দীর্ঘ সময় রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের সহিত কথাবার্তা বলিতে থাকিলেন এবং সকলের দৃষ্টির অগোচরে সাহাবাহ কেরাম রদিয়াল্লহু আ’নহুমদের অবস্থাও পর্যবেক্ষন করিতে থাকিলেন।

অতঃপর ফিরিয়া গিয়া কাফেরদের নিকট বলিলেন, হে কুরইশ! আমি বড় বড় রাজা বাদশার দরবারে গিয়াছি। কিসরা, কাইসার ও নাজ্জাশীর দরবারেও গিয়াছি। তাহাদের রীতিনীতি দেখিয়াছি। আল্লহর কসম! আমি কোন বাদশাকে দেখি নাই যে, তাহার লোকেরা তাহার এইরূপ সম্মান করে, যেইরূপ সম্মান মুহা’ম্মাদ (সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর লোকেরা তাঁহার সম্মান করে। যদি তিনি থুথু ফেলেন যাহার হাতে পড়িয়া যায়, সে উহা শরীরে ও চেহারায় মাখিয়া লয়। যে কথা মুহা’ম্মাদ (সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর মুখ হইতে বাহির হয় উহা পালন করার জন্য সকলেই ঝাঁপাইয়া পড়ে। তাঁহার অযুর পানি পরস্পর কাড়াকাড়ি করিয়া বন্টন করিয়া লয়, মাটিতে পড়িতে দেয় না। যদি কেহ পানির ফোঁটা না পায় তবে অন্যের ভিজা হাতে হাত মলিয়া নিজের মুখে মাখিয়া লয়। তাঁহার সামনে অত্যন্ত নিচু আওয়াজে কথা বলে, উচ্চ আওয়াজে কথা বলে না। আদবের কারণে তাঁহার দিকে চক্ষু উঠাইয়া দেখে না। যদি তাঁহার কোন দাঁড়ি বা চুল ঝরিয়া পড়ে তবে বরকতের জন্য উহা উঠাইয়া লয় এবং সম্মান করে। মোটকথা আমি কোন দলকেই আপন মনিবের সহিত এত মুহাব্বাত করিতে দেখি নাই, যত মুহাব্বাত মুহা’ম্মাদ (সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর লোকজন তাঁহার করিয়া থাকে।

এই অবস্থা চলাকালে মুহা’ম্মাদ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত উ’সমান রদিয়াল্লহু আ’নহু কে নিজের পক্ষ হইতে দূত হিসাবে মক্কার সরদারদের নিকট পাঠাইলেন। হযরত উ’সমান রদিয়াল্লহু আ’নহু মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও মক্কায় তাঁহার যথেষ্ট সম্মান ছিল এবং তাঁহার ব্যাপারে তেমন আশংকা ছিল না। এই কারণে রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁহাকে নির্বাচন করিয়াছিলেন। তিনি মক্কা গেলেন। সাহাবীদের (রদিয়াল্লহু আ’নহুম) ঈর্ষা হইল যে, উ’সমান তো আনন্দের সহিত কা’বাঘর তাওয়াফ করিতেছে। রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলিলেন, আমি আশা করি না যে, সে আমাকে ছাড়া তাওয়াফ করিবে। সুতরাং হযরত উ’সমান রদিয়াল্লহু আ’নহু যখন মক্কায় পৌঁছিলেন তখন আবান ইবনে সাঈ’দ তাঁহাকে নিরাপত্তা দিল এবং বলিল যে, যেখানে ইচ্ছা চলাফেরা করিতে পার, তোমাকে কেহ বাধা দিতে পারিবে না। হযরত উ’সমান রদিয়াল্লহু আ’নহু আবু সুফিয়ান ও মক্কার অন্যান্য সরদারদের সহিত সাক্ষাত করিতে থাকিলেন এবং রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের পয়গাম পৌঁছাইতে থাকিলেন। যখন ফিরিয়া আসিতে লাগিলেন তখন কাফিররা নিজেরাই অনুরোধ করিল যে, তুমি মক্কায় আসিয়াছ সুতরাং তাওয়াফ করিয়া যাও। তিনি জবাব দিলেন যে, ইহা আমার দ্বারা সম্ভব নয় যে, রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম কে বাধা দেওয়া হইয়াছে আর আমি তাওয়াফ করিব। কুরইশরা এই উত্তর শুনিয়া ক্ষিপ্ত হইয়া উ’সমান রদিয়াল্লহু আ’নহু কে আটক করিয়া রাখিল। মুসলমানদের নিকট এই সংবাদ পৌঁছিল যে, উ’সমান রদিয়াল্লহু আ’নহু কে শহীদ করিয়া দেওয়া হইয়াছে। ইহার উপর রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবাহ কেরাম রদিয়াল্লহু আ’নহুম দের নিকট হইতে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত লড়াই করিয়া যাওয়ার বাইয়াত গ্রহণ করিলেন। কাফেররা এই সংবাদ শুনিয়া ঘাবড়াইয়া গেল এবং উ’সমান রদিয়াল্লহু আ’নহু কে সঙ্গে সঙ্গে ছাড়িয়া দিল। (খামীস)

ফায়দাঃ এই ঘটনায় হযরত আবু বকর রদিয়াল্লহু আ’নহু এর উক্তি, হযরত মুগীরা রদিয়াল্লহু আ’নহু কতৃক আঘাত করা, সামগ্রিক ভাবে সাহাবাহ কেরাম রদিয়াল্লহু আ’নহুম দের আচরণ যাহা ওরওয়া গভীর ভাবে লক্ষ্য করিয়াছে, হযরত উ’সমান রদিয়াল্লহু আ’নহু কতৃক তাওয়াফ করিতে অস্বীকার করা–প্রত্যেকটি বিষয় রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি সাহাবাহ কেরাম রদিয়াল্লহু আ’নহুদের  অকৃত্রিম ও পরম ভালবাসার পরিচয় দেয়। উল্লিখিত ঘটনায় যে বাইয়াতের কথা আলোচিত হইয়াছে উহাকে ‘বায়াতুশ-শাজারা’ বলা হয়। কুরআন পাকেও উহার উল্লেখ রহিয়াছে। আল্লহ তায়া’লা সূরা ফাতহের لَقَدْ رَضِيَ اللَّهُ عَنِ الْمُؤْمِنِينَ-الاية ইহা উল্লেখ করিয়াছেন। পূর্ণ আয়াত তরজমাসহ পরিশিষ্টে আসিবে।

ফাযায়েলে আমাল (দারুল কিতাব, অক্টোবর ২০০১) পৃষ্ঠা ৮৫৪-৮৫৮

উহুদের যুদ্ধে হযরত আনাস ইবনে নজর রদিয়াল্লহু আ’নহু এর আ’মাল

উহুদের যুদ্ধে যখন মুসলমানদের পরাজয় হইতেছিল তখন কেহ এই গুজব রটাইয়া দিল যে, রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামও শহীদ হইয়া গিয়াছেন। এই ভয়াবহ সংবাদের যেইরূপ প্রভাব সাহাবাহ কেরাম রদিয়াল্লহু আ’নহুমদের উপর পড়িয়াছিল তাহা সুস্পষ্ট। এই কারণে মুসলমানরা আরও বেশী ভাঙ্গিয়া পড়িলেন। হযরত আনাস ইবনে নজর রদিয়াল্লহু আ’নহু হাঁটিয়া যাইতেছিলেন, এমন সময়ে আনসার ও মুহাযিরদের একটি দলের মধ্যে হযরত উ’মারহযরত তলহা রদিয়াল্লহু আ’নহুমা এর প্রতি দৃষ্টি পড়িল। তাঁহারা অত্যন্ত পেরেশান অবস্থায় ছিলেন। হযরত আনাস রদিয়াল্লহু আ’নহু জিজ্ঞাসা করিলেন, কি হইতেছে, মুসলমানদের চিন্তিত দেখা যাইতেছে কেন? তাঁহারা বলিলেন, রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম শহীদ হইয়া গিয়াছেন। হযরত আনাস রদিয়াল্লহু আ’নহু বলিলেন, তবে রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের পর তোমরাই বা জীবিত থাকিয়া কি করিবে? তরবারী হাতে লও এবং যাইয়া মৃত্যুবরণ কর। সুতরাং হযরত আনাস ইবনে নজর রদিয়াল্লহু আ’নহু নিজ তরবারী হাতে লইয়া কাফেরদের মধ্যে ঢুকিয়া পড়িলেন এবং ঐ সময় পর্যন্ত যুদ্ধ করিতে থাকিলেন যতক্ষন না শহীদ হইলেন। (খামীস)

ফায়দাঃ হযরত আনাস রদিয়াল্লহু আ’নহু এর উদ্দেশ্য ছিল, যাহার দর্শন লাভের জন্য বাঁচিয়া থাকার প্রয়োজন ছিল, যখন তিনিই থাকিলেন না তখন আর বাঁচিয়া থাকিয়া লাভ কি? সুতরাং এই কথার উপর নিজের জীবন উৎসর্গ করিয়া দিলেন।

ফাযায়েলে আমাল (দারুল কিতাব, অক্টোবর ২০০১) পৃষ্ঠা ৮৬২-৮৬৩